তারেক মাসুদ থেকে আবরার, ছোট রাস্তা থেকে মহাসড়ক, রিকশাযাত্রী থেকে বাসযাত্রী কেউই, কোথাও নিরাপদ নয়। নিরাপত্তা শব্দটিই এখন কোথাও নেই, অন্তত সড়কে নেই। এ কথাটি বলার জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। একজন সাধারণ মানুষই বলতে পারেন, আমাদের সড়কে কোনো ধরনের নিরাপত্তা নেই।
বছরের পর বছর একটি ফুটফুটে বাচ্চাকে মানুষ করে তুলতে একজন অভিভাবকের কী পরিমাণ অমানুষিক পরিশ্রম, ভালোবাসা, আত্মত্যাগ যে জড়িত তা আমরা জানি। সে বাচ্চা বা তরুণ যখন রাস্তায় নামছে তখন তাকে আমরা নিরাপত্তা দিতে পারছি না। প্রতিবার একজন মায়ের কোল খালি করছি আর বলছি ‘আমরা লজ্জিত!’ সত্যিই ধিক আমাদের নিজেকে। ধিক আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সবাইকে। ধিক ধিক ধিক।
এ দেশের সড়কে কে নিরাপদ? যার ব্যক্তিগত গাড়ি আছে তিনি? নাকি গণপরিবহনের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে গাড়ি ভাড়া করার সামর্থ্য আছে তিনি? এদের কেউ না কেউ, কখনও না কখনও রাস্তায় নামবেন তখন একটি যন্ত্রযান এসে তার জীবনটা কেড়ে নেবে না, এ নিশ্চয়তা কে দেবে?
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। মৃত্যুর সংখ্যা শুনতে শুনতে আমাদের চোখ, কান, শরীর সয়ে গেছে। সয়ে গেছে আমাদের গোটা ইন্দ্রিয়। এ ৭ হাজার ২২১ জনকে একসঙ্গে করে দেখেন তাহলে বুঝবেন সংখ্যাটা আসলে কত বড়, কত বিশাল। কতটা অসহায় আমরা এ সড়ক, মহাসড়কের কাছেÑ তা দুর্ঘটনার এক তথ্যতে স্পষ্ট।
আবরার আহমেদ চৌধুরী। ২০ বছর বয়সি মেধাবী তরুণ। এ তরুণের আমাদের দেশকে অনেক কিছুই দেওয়ার কথা ছিল, ছিল দেশের একজন হয়ে সুনাম অক্ষুণœ রাখার কথা, ছিল বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু সে তরুণকে একজন বাসচালকের হাতে প্রাণ দিতে হলো। সিরাজুল ইসলাম নামের যে চালক তরুণ আবরারের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে তার বয়স ঊনত্রিশ। যার প্রাণ গেল আর যে প্রাণ নিল দুজনের বয়স ‘দুই’য়ের ঘরে। দুর্ভাগ্য একজন জীবিত, একজন মৃত। বাসচালক সিরাজুল ওই দিনই একজন নারীকে ধাক্কা মারে। তার গাড়ি চালানো কেমন হতে পারে তা আর নতুন করে কাউকে বলতে হবে না।
২.
২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ঘোষণা দিয়েছিল, ফিটনেসবিহীন গাড়ি আর চলবে না। রাজধানী থেকে ২০ বছরের পুরোনো সব বাস তুলে দেওয়া হবে। তার দুই বছর পর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন ওবায়দুল কাদের। মন্ত্রিত্ব নেওয়ার এক বছর পর তিনি ফিটনেসবিহীন যানবাহন তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিলেন। তা আর কার্যকর হলো না।
দীর্ঘ আট বছর ধরে দেশবাসী শুধু ঘোষণাই শুনল। এসব ঘোষণা আর বাস্তবায়িত হলো না। ফিটনেসবিহীন গাড়ি যে সড়কে বীরদর্পে চলেছে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে স্কুল-কলেজের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। নড়বড়ে-ভাঙাচোরা বাস, লাইসেন্সবিহীন চালক, নিয়ম না মানার প্রতিযোগিতা সবই যেন একের পর এক লাইনে সাজানো। মন্ত্রী, পুলিশ বা সরকারি গাড়ির চালকও যে ‘ফিটনেসবিহীন’ তা গতবারই নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আবিষ্কার করেছিল। গোটা যোগাযোগ খাতটি কতটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে চলছে তার নমুনা পাওয়া যায় এতে।
এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাওয়া যাক, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) সাময়িক হিসাবে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ, যা এযাবৎকালের রেকর্ড। বাংলাদেশে এর আগে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়নি। প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি মাথাপিছু আয়ও বাড়বে। মাথাপিছু বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়াবে এক হাজার ৯০৯ ডলার।
আবার ২০১৭ সালের আগস্টে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণার তথ্যমতে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এসব দুর্ঘটনার কারণে বছরে মোট জাতীয় উৎপাদনের ২ থেকে ৩ শতাংশ হারাচ্ছে বাংলাদেশ। একদিকে আমাদের জিডিপি যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় মেধাবী প্রাণ হারাতে হারাতে আমাদের জিডিপি কমছে।
৩.
যদি চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানো বন্ধ না হয়, যদি গোটা পরিবহন খাতকে কঠোর নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, যদি পরিবহন মালিকদের কারণে সরকারি দ্বিতল বাস বন্ধ থাকে, যদি পরিবহন মালিকদের কারণে নৌপথ এবং রেলপথকে অব্যবস্থাপনায় ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়, যদি ছোট থেকে শুরু করে মহাসড়কের চালকদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা না যায়, যদি গোটা পরিবহন খাতকে ঢেলে সাজিয়ে বৃহৎ পরিকল্পনা করা না যায় এবং সর্বোপরি যাত্রীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি না হয় তবে কখনোই সড়কে শান্তি এবং স্বস্তি ফিরবে না।
কখনও আমার সন্তান, কখনও আপনার সন্তান বা কখনও আমি, কখনও আপনি সড়কেই মারা যাব। কখনও আমার মায়ের বুক খালি হবে, কখনও আপনার মায়ের বুক খালি হবে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে নেমে ছাত্রদের গলা ফাটানো বিক্ষোভ দেখেই বোঝা যায় তারা আমাদের প্রশাসনের ওপর কতটা বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ। যেখানে স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছেলেমেয়েদের আমরা সন্তুষ্ট করতে পারছি না, তাদের একটা দাবি আমরা পূরণ করতে পারছি না, সেখানে তারা কীসের আশায় আমাদের ওপর ভরসা করবে? কেন ভরসা করবে? হ
বিনয় দত্ত
কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক