বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষ জীবনের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন। তাদের প্রায়ই ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগের মোকাবিলা করতে হয়। আর হয় জানমালের ব্যাপক ক্ষতি। অবশ্য এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই। এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার ওপর মানুষের হাত নেই। তবে কিছু তো করণীয় আছে বটে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৫৮২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ৪৬টি বড় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয় উপকূলীয় এলাকায়। সবচেয়ে মারাত্মক ছিল ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। ৭ থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত চলেছিল এ তা-ব। সমগ্র বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান), চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, চর বোরহানুদ্দিনের উত্তর পাশ, চর তজুমুদ্দিন এবং মাইজদী ও হরিণঘাটার দক্ষিণ পাশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি হিসাব অনুসারে, মৃতের সংখ্যা ৫ লাখ; কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি ধারণা করা হয়। ক্ষতির মধ্যে আনুমানিক ২০ হাজার মাছ ধরা নৌকা, শস্য ও সম্পদ। গবাদিপশু মৃত্যু প্রায় ১০ লাখ, বাড়িঘর ৪ লাখ এবং সাড়ে তিন হাজার শিক্ষাকেন্দ্র বিধ্বস্ত হয়েছিল। এরপর ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে, ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে, ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে, ১৯৭৫ সালের মে মাসে, ১৯৭৭ সালের মে মাসে, ১৯৮৩ সালের অক্টোবর মাসে, একই বছর নভেম্বর মাসে, ১৯৮৫-১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাসে, ১৯৮৮ সালের নভেম্বও, ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে, ২৯-৩০ এপ্রিল ১৯৯১ সালের এপ্রিলে, ১৯৯৪ সালের মে মাসে, ২১-২৫ নভেম্বর ১৯৯৫ সালের নভেম্বর, ১৯৯৭ সালের মে মাসে, একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে, ১৯৯৮ সালের মে মাসে, ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে, ২০০৭ সালের ১৪-১৫ মে মাসে অনেক ছোট-বড় ও মাঝারি ধরনের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক জানমালের ক্ষতি হয়। বড় ধরনের আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিডর ২০০৭ সালে। সিডর ২৬০ কিলোমিটার ঘণ্টা বেগে বাংলাদেশের দক্ষিণের উপকূল বরাবর আঘাত হানে এবং ফলশ্রুতিতে সাড়ে তিন হাজারের অধিক মৃত্যু এবং মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হয়। এরপর ২০০৮ সালের ২৬-২৭ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় রেশমির আঘাত। ১৯-২১ এপ্রিল ২০০৯ সালের এপ্রিলে ঘূর্ণিঝড় বিজলি আর একই বছরের এপ্রিলে বড় আঘাত আইলার। ১-১৭ মে ২০১৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ভিয়ারু, ২৯ জুলাই ২০১৫ সালের জুলাইয়ে কোমেন, ২১ মে ২০১৬ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু, ২০ আগস্ট ২০১৬ সালের আগস্টে ঘূর্ণিঝড় ডিয়ামুর আংশিক আঘাত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের কারণে ক্ষয়ক্ষতি বেড়েই চলছে। এ পর্যন্ত কত লোক আর সম্পদের ক্ষতি হয়েছে তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। তবে ১৯৬৫ সালের প্রথম দফার ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১৯ হাজার ২৭৯ জন আর দ্বিতীয় দফায় ৮৭৩ জন প্রাণ হারায়। ১৯৭০ সালে প্রাণ হারায় ৩ লাখ। ১৯৮৫ সালে ১১ হাজার ৬৯ জন, ১৯৯১ সালে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন, ১৯৯৭ সালে ১৫৫, ২০০৭ সিডরে ৩ হাজার ৩৬৩ জন আর ২০০৯ সালের আইলায় ১৯০ জনের প্রাণহানির তথ্য পাওয়া যায় সরকারি হিসাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগÑ তাই এর ওপর মানুষের হাত নেই। তবে এসব দুর্যোগ থেকে জানমালের ক্ষতি কমানোর উপায় তো আছে। আর সরকারি ও বেসরকারিভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ এবং পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল প্রতি বছরই জলোচ্ছ্বাস এবং উপকূলীয় ভাঙনের সম্মুখীন হয়ে থাকে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, প্রচলিত পদ্ধতিতে সারিবদ্ধভাবে বৃক্ষরোপণ করে জলোচ্ছ্বাসের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি বরং উপকূলরেখার সম্মুখ বরাবর ব্যাপক বনায়নের মাধ্যমে এবং চর এলাকায় গরান বনভূমি সৃষ্টির মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হতে পারে। রাস্তার ধার এবং বেড়িবাঁধ বরাবর বৃক্ষরোপণ নিঃসন্দেহেই সবুজবেষ্টনী গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি উপকূলীয় ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধেও অবদান রাখছে। তবে এটিই সবুজবেষ্টনী রচনার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। সবুজবেষ্টনী রচনার দুটি প্রধান উদ্দেশ্য হলোÑ ১. বেড়িবাঁধের সম্মুখ ঢালকে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে রক্ষা করা এবং ২. উপকূলীয় এলাকায় জানমাল ও কৃষি জমিকে রক্ষা করা। এছাড়াও বনায়নের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গরান বন রক্ষা ও পুনর্বাসন করা। সমুদ্র এবং নদীর বাঁধ বরাবর বহুবর্ষজীবী বৃক্ষরোপণের কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী প্রকল্প দেশের ক্ষয়িষ্ণু বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকাগুলোয় সাইক্লোনের কারণে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়ে থাকে। ১৯৯১ সালে এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হানে, যেখানে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২০০ কিলোমিটার আর সমুদ্র থেকে উঠে আসা বিশাল ঢেউগুলো ছিল প্রায় ৬ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট। ভয়াবহ এ ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। জনসাধারণের ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য স্থাপত্যসহ প্রায় ২৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণ সম্পত্তি বিনষ্ট হয়। এ ঝড় এবং এর পূর্ববর্তী অন্যান্য ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতা থেকেই প্রতীয়মান হয়েছে যে, উপকূলবর্তী এলাকায় ব্যাপক বনায়ন বিশেষ করে ম্যানগ্রোভ জাতীয় বৃক্ষরোপণ এসব ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। ১৯৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের পরই বাংলাদেশ সরকার উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পটি সূত্রবদ্ধকরণের কাজ চলে ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৯৪ সালের মার্চ পর্যন্ত এবং ১৯৯৫ সালের ২ মার্চ এটি এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ঋণবিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখে। ২০০২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত শেষ সময়সীমা নির্ধারণ করে ২৮ জুলাই থেকে প্রকল্পটি কার্যকর ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীকালে এ সীমারেখার সামান্য সংশোধন করে সমগ্র ভোলা জেলাকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ প্রকল্পে মোট ১০টি বন বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে : ১. পটুয়াখালী বন বিভাগ (বরগুনা এবং পটুয়াখালী জেলা নিয়ে গঠিত), ২. চট্টগ্রাম বন বিভাগ (চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার নিয়ে গঠিত), ৩. ভোলা বন বিভাগ, ৪. লক্ষ্মীপুর বন বিভাগ, ৫. নোয়াখালী বন বিভাগ, ৬. ফেনী বন বিভাগ, ৭. পিরোজপুর বন বিভাগ, ৮. বাগেরহাট বন বিভাগ, ৯. বরিশাল বন বিভাগ এবং ১০. ঝালকাঠি বন বিভাগ। উল্লিখিত বন বিভাগগুলোয় প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর জমি অন্তর্ভুক্ত, যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নির্মিত বাঁধে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ঘন বনায়নের পরিকল্পনা ছিল। প্রকল্পটি শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৩৯৪ কিলোমিটার এলাকায় বৃক্ষরোপণ শেষ হয়। রেললাইনের ধারে বাংলাদেশ রেলওয়ের ২০ কিলোমিটার জমিতে, বিশ্বরোড এবং ‘রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে’ ডিপার্টমেন্টের অধীন ছোট রাস্তাগুলোর প্রায় ৪১০ কিলোমিটার এলাকায়, সরকারি প্রকৌশল বিভাগের অধীনে ‘বি’ টাইপের ছোট রাস্তাগুলোর ২৮০ কিলোমিটার অংশ এবং গ্রামাঞ্চলের ছোট রাস্তাগুলোর প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার এলাকায় বৃক্ষরোপণ এ প্রকল্পের পরিকল্পনাধীন ছিল। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে সৃষ্ট ঘন বনাঞ্চল উপকূলীয় পরিবেশের উন্নয়নে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া এর ফলে জনগণের মধ্যে বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতাও সৃষ্টি হয়েছে। একেবারে তীরবর্তী অঞ্চলে আরও অধিক পরিমাণ বৃক্ষরোপণ করা গেলে তা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এসবের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। হ
ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম
বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন