রমজানের রোজা ইসলামের অন্যতম একটি ফরজ ইবাদত। ধনী-নির্ধন, সাদা-কালো, আমির-ফকির নির্বিশেষে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে। আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশুদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে রোজা হচ্ছে প্রশিক্ষণস্বরূপ।
‘রোজা’ শব্দটি এসেছে ফার্সি শব্দ থেকে, যার আরবি পরিভাষা হলো সাওম বা সিয়াম। পবিত্র কোরআনে রোজাকে ‘রমাদান’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যার অর্থ দাহন বা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া। এখন প্রশ্ন হতে পারে কিসের দাহন? মানবজীবনের কুপ্রবৃত্তির দাহন। এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, মানবজীবনে রয়েছে কতগুলো সু ও কুপ্রবৃত্তি। সুপ্রবৃত্তিগুলো আমাদের অন্তরে আল্লাহর ভয়ভীতি এবং তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করে। এর দ্বারা মানুষের স্বভাবে নম্র্রতা ও বিনয় সৃষ্টি করে এবং সমাজজীবনে সংহতি, ঐক্য, প্রেম, মৈত্রী ও ভালোবাসা সৃষ্টিতে সহায়তা করে। অন্যদিকে কুপ্রবৃত্তিগুলো লোভ, মোহ, মাৎসর্য, নেশা, মিথ্যা, প্রতারণা ও অশ্লীলতা চর্চার মাধ্যমে আমাদের সামাজিক জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। কামপ্রবৃত্তির ফলে মানুষ পশুত্বের চরম নিম্নস্তরে নেমে যায়। ক্রোধ মানুষকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে তোলে। এ কুপ্রবৃত্তিগুলো দাহনের জন্য আল্লাহ তায়ালা রোজার বিধান প্রবর্তন করেছেন।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেনÑ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজাকে ফরজ করা হয়েছে। যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া বা পরহেজগারি অর্জন করতে পার।’ (সূরা বাকারা : ১৮৩)।
তাকওয়া বা পরহেজগারির শক্তি অর্জন করার ব্যাপারে রোজার একটা বিশেষ ভূমিকা বিদ্যমান। কেননা রোজার মাধ্যমে প্রবৃত্তির তাড়না নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে বিশেষ শক্তি অর্জিত হয়। যার মধ্যে এ শক্তি সৃষ্টি হবে তাকে বলা হয় ‘মুত্তাকি’।
মুত্তাকিদের উদাহরণ দিতে গিয়ে হজরত উবাই বিন কাব (রা.) হজরত ওমর (রা.) কে বলেছিলেন, ‘কাঁটাযুক্ত ও সংকীর্ণ রাস্তায় খুব সতর্কতার সঙ্গে যেমন চলতে হয় তাই হচ্ছে তাকওয়া।’ বিখ্যাত ফকিহ আল্লামা আবু লাইস সামারকান্দি (রহ.) তার ‘তাম্বিহুল গাফেলিন’ নামক কিতাবে লিখেছেনÑ ‘প্রকৃত খোদাভীতি হলো দৃষ্টিকে অবৈধ দৃশ্য থেকে ফিরিয়ে রাখা এবং জিহ্বাকে মিথ্যা ও গিবত থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে যাবতীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে হারাম কাজ থেকে বিরত রাখা।’
রোজার মাধ্যমে অর্জিত তাকওয়ার প্রভাব মোমিনের গোটা জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। যার ফলে সে কখনও অন্যায় কাজ করতে পারে না। খাবারের চাহিদা ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রোজা পালনকারী স্বীয় প্রবৃত্তির ঘোড়াকে লাগামবদ্ধ করে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রোজা ঢালস্বরূপ।’ (বোখারি : ১৯০৪)। ঢাল যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধাকে শত্রুর আঘাত থেকে রক্ষা করে, রোজাও তেমনি বান্দাকে শয়তানের প্রবঞ্চনা ও কুপ্রবৃত্তির প্ররোচনা থেকে রক্ষা করে। এতে বান্দার ঈমান দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে দ-ায়মান হওয়াকে ভয় করে এবং স্বীয় প্রবৃত্তিকে রিপুর অনুসরণ থেকে বিরত রাখে তার ঠিকানা হবে জান্নাত।’ (সূরা নাজিআত : ৪০-৪১)।
মানুষের মধ্যে দুই ধরনের বৈশিষ্ট্য রয়েছেÑ ১. মালাকুতি বা ফেরেশতাদের স্বভাব, ২. পাশবিক বা ইবলিসি স্বভাব। ইবলিসি স্বভাব তাকে স্বেচ্ছাচারিতার পথে পরিচালিত ও সংযমহীন রূপে গড়ে তোলে। এর ফলে সমাজে নানা ধরনের দ্বন্দ্ব, সংঘাত, হত্যা-ছিনতাই, লুটপাট ইত্যাদি চারিত্রিক স্খলনের সৃষ্টি হয়। আর রোজার মাধ্যমে মানুষ ফেরেশতা চরিত্রের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে। রোজা চরম খাদ্য বিলাসীকেও সংযমী করে তোলে। পেট যখন ভরা থাকে তখন অন্যের ক্ষুধার কষ্ট অনুভব করা যায় না। জিহ্বা যখন পানিতে ভেজা থাকে তখন অন্যের পিপাসার কষ্ট অনুভব করা যায় না। সর্বক্ষেত্রে রোজার মাধ্যমে আত্মসংযম ও সবরের শিক্ষা পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সিয়াম সবরের অর্ধেক এবং সবর ঈমানের অর্ধেক।’ (কিমিয়ায়ে সাআদাত : ২০৯)। ধৈর্যের মাধ্যমে রোজা মানুষের অন্তরকে পরিশোধিত এবং আল্লাহর সান্নিধ্যের অন্তরায় যাবতীয় অভ্যাস অপসারিত করে। মানুষের মধ্যে যে সহজাত পাপ প্রবণতা রয়েছে আল্লাহ ভীতির দ্বারা রোজা এ পাপ থেকে বিরত থাকতে শেখায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুয়ায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বোখারি : ১৯০৩)। অর্থাৎ রোজা পালনকারী হাদিস মতে, এসব গর্হিত কাজে লিপ্ত হলে সে কিছুই পেল না সিয়াম থেকে। আর যদি বান্দা এসব থেকে বিরত থাকতে পারে তাহলে ধরে নেওয়া যায়, বান্দা তাকওয়ার স্তরে উন্নীত হয়েছে।
মূলত তাকওয়াই হচ্ছে জান্নাত লাভের অপরিহার্য শর্ত। পবিত্র কোরআনে যেখানে জান্নাতের কথা আলোচনা করা হয়েছে, সেখানে তাকওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সে জান্নাতের উত্তরাধিকারী আমি অবশ্যই তাদের বানাব, আমার বান্দাদের মধ্যে যারা তাকওয়ার অধিকারী।’ (সূরা মরিয়ম : ৬৩)।
তাই আল্লাহ তায়ালা তাকওয়ার গুণসম্পন্ন মুত্তাকি সৃষ্টির জন্য রমজান মাসের সিয়াম সাধনা অপরিহার্য করেছেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে এ রমজানকেই জীবনের শেষ রমজান মনে করে এর যথাযথ হক আদায় করার তাওফিক দান করেন। আমিন।
লেখক : শিক্ষক, জিন নুরাইন ওয়ালিয়া সুন্নিয়া মডেল মাদ্রাসা, আশকোনা, দক্ষিণখান, ঢাকা