আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ৬-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

বিএনপির সংসদে যাওয়া নিয়ে বিতর্ক চলছেই

রকীবুল হক
| প্রথম পাতা

- সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না : ফখরুল

- সমালোচনামুখর নেতাকর্মীরা তারেকের সিদ্ধান্ত নিয়ে

নাটকীয়ভাবে সিদ্ধান্ত বদল করে বিএনপির এমপিদের সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে এখনও বিতর্ক চলছে দল ও জোটে। ভোট ডাকাতির অভিযোগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফল বর্জন ও শপথ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও শেষ মুহূর্তে তা পাল্টানোর যৌক্তিকতা সম্পর্কে এখনও অন্ধকারে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীরা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় চার এমপির সংসদে যাওয়ার এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। তবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের শপথ না নেওয়ার বিষয়টিও রহস্যজনক হিসেবে দেখছেন অনেকে। এ নিয়ে দলের ভেতরে নানামুখী প্রতিক্রিয়ার পর রোববার এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব জানিয়েছেন, সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। তার এ বক্তব্য দল ও জোটে বিতর্কের নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। তবে বিএনপি মহাসচিবের এ বক্তব্যের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন। যদিও দলটির নতুন সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া বলেছেন, পাঁচজনকে দয়া করে সংসদে ঢুকতে দিলেই এ সংসদের বৈধতা হবে সেটা ভুল ধারণা।
বিএনপির সাম্প্রতিক কর্মকা-ে এরইমধ্যে একটা বড় বিতর্ক উঠেছে মন্তব্য করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মান্না রোববার বলেন, যখন চারজন সংসদ সদস্য শপথ নিলেন তখন অনেকের মনে হয়েছে, নিশ্চয়ই এবার বেগম জিয়া মুক্তি পাবেন। অথচ শপথ নেওয়ার পরদিন আপনারা দেখেছেন মামলা আদালতে উঠেছে, সেই মামলা দুই মাস পিছিয়ে গেছে। আমি বলতে চাই, এ সব করে কোনোভাবেই মুক্তির পথ খুলবে না, এ সব করে আপসের পথ খুঁজলে যদি মনে করেন কোনো রকম সমঝোতা করা যাবে, সেই পথে বেগম জিয়ার মুক্তি হবে না, গণতন্ত্রের বিজয় হবে না, নতুন করে নির্বাচন আদায় করতে পারবেন না।
এদিকে সিদ্ধান্ত বদল করে বিএনপির এমপিদের সংসদে যাওয়ার বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটি, ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আগামী বৈঠকে ব্যাখ্যা চাওয়ার অপেক্ষায় আছেন সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে বিএনপির হাইকমান্ড তৃণমূল নেতাকর্মীদের বেশ চাপে আছেন বলে জানা গেছে। শনিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও পরে তা বাতিল করা হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
গেল ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা পায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। নির্বাচনে মাত্র আটটি আসনে জিততে পারে বিএনপিকে নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এরমধ্যে বিএনপির ছয়জন এবং গণফোরামের দুইজন নির্বাচিত হন। তবে এ নির্বাচনে অনিয়ম ও ভোট ডাকাতির অভিযোগ এনে এর ফল ও শপথ অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দেয় বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এরপর থেকেই শপথ গ্রহণের শেষ সময় পর্যন্ত কী হয় তা পর্যবেক্ষণে ছিলেন সরকার ও রাজনৈতিক মহল। শুরু থেকেই দলীয় ও জোটের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে শপথের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। 
এক পর্যায়ে ঐক্যফ্রন্টের শরিক গণফোরাম থেকে নির্বাচিত দুইজনের মধ্যে মৌলভীবাজার-২ আসনের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ ৭ মার্চ এবং সিলেট-২ আসনের মোকাব্বির খান ২ এপ্রিল জোটের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে শপথগ্রহণ করেন। এতে বিএনপি জোটে চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তাৎক্ষণিকভাবে সুলতান মনসুরকে গণফোরাম ও ঐক্যফ্রন্ট থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আর মোকাব্বির খানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
গণফোরামের পর বিএনপির ছয় এমপিরও শপথের সম্ভাবনার কথা জোরদার হলেও দলটি থেকে তা দৃঢ়ভাবে নাকচ করা হচ্ছিল। এরইমধ্যে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ২৫ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের জাহিদুর রহমান শপথ নেন। এ ঘটনায় তাকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়।
কিন্তু এর চার দিনের মাথায় দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শপথগ্রহণ করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া, বগুড়া-৪ আসনের মো. মোশাররফ হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের আমিনুল হক ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের মো. হারুনুর রশীদ। শপথগ্রহণের পর এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, তারেকের নির্দেশে দলীয়ভাবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে দলীয় কৌশলের কথা বলে শপথ থেকে তিনি নিজে বিরত থাকেন। একপর্যায়ে বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচিত ফখরুলের আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়। 
আকস্মিক এ সব সিদ্ধান্ত নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে এখনও নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের সঙ্গে গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে বিএনপি সংসদে যাওয়ার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। তারেকের নির্দেশনায় সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলীয় জোটের কাউকে এ বিষয়টি জানানো হয়নি বলেও অভিযোগ উঠেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগামী বৈঠকে এসব বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়ার অপেক্ষায় আছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না Ñফখরুল : রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা অতীতে বলেছিলাম যে, আমরা (সংসদে) যাব না, সেই সময় তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল বলে মনে হয় না।
নিজে শপথ না নিলেও এ বিষয়ে নিজের উপলব্ধির কথা তুলে ধরে ফখরুল বলেন, শুধু সস্তা স্লোগান দিয়ে কথা বললে চলবে না। সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান (তারেক রহমান) মহোদয়। এ কারণেই যে, আমাদের দুই দিকেই লড়াইটা করতে হবে। ওই ভেতরে থেকেও কথা বলতে হবে, বাইরে থেকেও কথা বলতে হবে। 
বিএনপি ঐক্যবদ্ধ আছে এবং দলে কোনো সমস্যা নেই দাবি করে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা কঠিন সময় অতিক্রম করছি। এ কঠিন-সংকটময় মুহূর্তে আমাদের কমিটমেন্ট রাখতে হবে। বিপদ সামনে নিয়েও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কখনও নিরাশ হবেন না, হতাশ হবেন না। বুক বেঁধে সোজা হয়ে দাঁড়ান। নেভার গিভ আপ।
দলের বিষয়ে কোনো বক্তব্য থাকলে তা দলীয় ফোরামের বাইরে না বলার জন্য নেতাদের প্রতি অনুরোধ রাখেন বিএনপি মহাসচিব।
এর আগে শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুলের শপথ না নেওয়া প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, প্রশ্ন উঠেছে, সবাই পার্লামেন্টে গেল মহাসচিব গেল না কেন? এটা আমার কাছেও খটকা লাগে, দলের সিদ্ধান্তে সবাই গেলে মহাসচিব যাবেন না কেন? নিশ্চয়ই সে বিষয়ে ব্যাখ্যা তিনি দেবেন।
আর দলটির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সংসদে যাওয়ার এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ‘কনফিউশন’ তৈরি হয়েছে এটা সঠিক। দলীয় সূত্র জানায়, শেষ মুহূর্তে ফখরুল ছাড়া চার এমপির শপথগ্রহণকে কেন্দ্র করে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে বিএনপিতে। এ নিয়ে দলটির মধ্যে এখনও অস্থিরতা চলছে। স্থায়ী কমিটির বেশিরভাগ সদস্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এ সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও মন থেকে তা গ্রহণ করেননি। অন্যদিকে তারেক রহমান তথা দলীয় সিদ্ধান্তের কথা বলা হলেও মহাসচিব কেন শপথ নেননি, ভেতরে ভেতরে কেউ কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করছে। 
সূত্রমতে, দলের বিভিন্ন পর্যায়ে এমন আলোচনা ও গুঞ্জনের মধ্যে শনিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকেও শেষে তা বাতিল করা হয়। 
এদিকে বিচ্ছিন্নভাবে বিএনপি ও গণফোরামের এমপিরা শপথ নিয়ে সংসদে গেলেও তাদের ভূমিকা কি হবে এ নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা অন্ধকারে রয়েছেন। এ বিষয়ে ঐক্যফ্রন্টের মিডিয়া সমন্বয়ক ও গণফোরাম নতুন কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক লতিফুল বারী হামিম বলেন, বিষয়টি নিয়ে জটিল সমীকরণ তৈরি হয়েছে। আগামীতে ঐক্যফ্রন্টের বৈঠক হলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।