বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা মানুষের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারছে না। বেকার সৃষ্টি করছে মাত্র। এই শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে আগামী দিনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত মানসম্পন্ন শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই
বিশ্বব্যাপী সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি মনুষ্য সৃষ্ট সম্পদও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সম্পদ বৃদ্ধির এ সুফল সবাই সব হারে ভোগ করতে পারছে না। কারণ সম্পদ বা আয় বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সম্পদ বৈষম্য। মানুষের ভোগ এবং ভোগের চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও সবার ব্যয়ের সামর্থ্য একই সঙ্গে সমান তালে বাড়ছে না। ফলে সবাই ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পদ ভোগ করতে পারছে না। ফলে সর্বব্যাপী সাধারণ দরিদ্র শ্রেণির মানুষের মাঝে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে। সৃষ্টি হচ্ছে সম্পদ আহরণের দুর্বার প্রতিযোগিতা। কিন্তু সবাই তো আর চাইলেই সম্পদ আহরণ করতে পারে না। আগেকার দিনে সম্পদ আহরণের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হতো দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার। কিন্তু এখন সম্পদ আহরণের জন্য বেশি প্রয়োজন হয় অর্থশক্তি এবং পেশিশক্তির। কারণ বৈধ উপায়ে সম্পদ আহরণের সুযোগ প্রতিনিয়তই কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি অবৈধভাবে বা দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে সম্পদ উপার্জনের সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া বৈধ পথে সম্পদ আহরণের জন্য পরিশ্রম করতে হয়; কিন্তু অবৈধভাবে সম্পদ আহরণের জন্য তেমন একটা পরিশ্রম করতে হয় না। সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে বৈধ পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রচলিত মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটছে। আগে অবৈধভাবে সম্পদ আহরণকারী ব্যক্তি সমাজে মাথা নিচু করে থাকতেন। তারা সামাজিকভাবে নিজেদের হেয় মনে করতেন, যদিও সম্পদ সবসময়ই শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে এমন সময় আমরা অতিক্রম করছি, যেখানে সম্পদ উপার্জনই মানুষের কাছে মুখ্য বিষয়, বৈধ-অবৈধতার বিষয় সেখানে গৌণ। মূলত সে কারণেই আমরা দেখি দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে সম্পদ অর্জনকারী ব্যক্তিও সমাজে মাথা উঁচু করে চলে। তারপরও সমাজে সম্পদ অর্জনের তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। এ প্রতিযোগিতায় কেউ বিজয়ী হচ্ছেন কেউ বা বিজয়ী হতে পারছেন না।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী সম্পদ বৃদ্ধি এবং সম্পদ বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক এবং মনুষ্য সৃষ্ট সম্পদ উভয়ই বাড়ছে। এ বৃদ্ধিটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, যেসব দেশ প্রাকৃতিক সম্পদ সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন নতুন সম্পদ এবং উপযোগিতা সৃজন করতে সমর্থ হয়েছে মূলত তারাই সফল হয়েছে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক, তাহলো প্রাকৃতিক সম্পদ শুধু থাকলেই একটি দেশ উন্নত হতে পারবে, এমনটি না-ও হতে পারে। সেই সম্পদ ব্যবহারের মতো সামর্থ্য থাকাটাও জরুরি। কথায় বলে, ‘গরিবের বউ সবার ভাবি।’ অর্থাৎ দরিদ্র মানুষের ঘরে সুন্দরী বউ থাকলে তার নানা বিপদ হতে পারে, তেমনই দরিদ্র দেশের সম্পদ থাকলে তা-ও সংশ্লিষ্ট দেশটির জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। এক্ষেত্রে নাইজেরিয়ার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। দেশটি একসময় প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ ছিল। সেই সম্পদের লোভে বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশগুলো সে দেশে প্রবেশ করে। নাইজেরিয়ার মানবসম্পদ ছিল খুবই দুর্বল প্রকৃতির। ফলে তারা প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের সামর্থ্য রাখত না। এ সুযোগে বিদেশি চক্র দেশটির সম্পদ লুটে নেয়। এখন নাইজেরিয়া বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যে দেশ মানবসম্পদ উন্নয়নে যত বেশি সফলতা দেখিয়েছে তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও তত এগিয়ে গেছে। তাই এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে, একটি দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হলেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করতে পারবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানবসম্পদের উন্নয়ন এবং সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা। বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বিশ্বব্যাপী দরিদ্র দেশগুলোর মোট সম্পদের অর্ধেকই প্রাকৃতিক সম্পদ। অন্যদিকে ধনী বা বিত্তবান দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু তারা মানবসম্পদে উন্নত। বিশ্বব্যাপী মোট সম্পদের বড় অংশ এখন মানবসম্পদ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে মানবসম্পদ ব্যবহারের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৪১ দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। বর্ণিত সময়ে বিশ্বব্যাপী সম্পদ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এ সময় মধ্যম আয়ের দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তবে একই সঙ্গে বিত্তবান এবং বিত্তহীনের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। কারণ সম্পদ উৎপাদিত হলেও তার বণ্টনব্যবস্থা এখনও ন্যায্যতার ভিত্তিতে নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে যে সম্পদ উপার্জিত হচ্ছে, তা সামান্য কিছু ভাগ্যবান মানুষের কাছে গিয়ে পুঁঞ্জীভূত হচ্ছে। ‘সম্পদ আরও সম্পদ আনে’Ñ এ নীতিতে চলছে বিশ্ব। যারা বেশি সম্পদের মালিক তাদের সম্পদের পাহাড় ক্রমে স্ফীত হচ্ছে। কোনো অর্থব্যবস্থাই বিত্তবান-বিত্তহীনের ব্যবধান হ্রাস করতে পারছে না। একসময় মনে করা হতো অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্রাকৃতিক সম্পদই একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপকরণ। কিন্তু এখন সেই প্রচলিত ধারণা ক্রমে ভ্রান্ত বলে প্রতীয়মান হতে চলেছে। বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মানবসম্পদ যে সবচেয়ে বড় উপকরণ তা এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ একটি দেশে নতুন নতুন সম্পদের উপকরণ উদ্ভাবন এবং তা ব্যবহারের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ থাকাটা খুবই জরুরি। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের অভাবে একটি দেশ কাক্সিক্ষত মাত্রায় উন্নয়ন সাধন না-ও করতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প খাতের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে কারও মনে কোনো ধরনের দ্বিধা থাকার কথা নয়। আমরা এই শিল্প খাত নিয়ে প্রায়ই গৌরব অনুভব করে থাকি। কিন্তু আমরা কি একবারও এ খাতের দুর্বলতার দিকটি ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করি? বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিশেষ করে পণ্য রপ্তানি খাতে তৈরি পোশাক শিল্প অনেক দিন ধরেই শীর্ষস্থান দখল করে আছে। এটি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস। তৈরি পোশাক শিল্প খাতটি রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থানে রয়েছে। এমনকি ভারতও বাংলাদেশের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। প্রচুর সংখ্যক মহিলা শ্রমিক এখানে কাজ করছে। আমরা এ খাতকে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের একটি চমৎকার উৎস হিসেবে বিবেচনা করি। কিন্তু একবারও আমাদের মনে উদয় হয় না যে, এই খাতে স্থানীয় যেসব শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করছে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন? তারা কীভাবে শোষিত হচ্ছে? নামমাত্র মজুরিতে মহিলাদের এখানে কাজ করানো হয়। আমরা বিভিন্ন কারখানায় মহিলা শ্রমিকদের কাজ করতে দেখলে উল্লসিত হই। কিন্তু ভেবে দেখি না পুরুষ শ্রমিক থাকতে কেন মহিলা শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হয়? কয়েক বছর আগে গোড়াই এলাকার একটি ব্যাটারি কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে প্রচুর মহিলা শ্রমিককে কর্মরত দেখতে পাই। আমি কর্তব্যরত ফ্যাক্টরি ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করি এলাকায় পুরুষ শ্রমিকের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও আপনারা মহিলা শ্রমিক দিয়ে কাজ করাচ্ছেন কেন? তিনি জানালেন, মহিলা শ্রমিক দিয়ে কাজ করালে নানা ধরনের সুবিধা পাওয়া যায়। প্রথমত, মহিলা শ্রমিকরা তুলনামূলক কম মজুরিতে কাজ করে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিকদের প্রায় অর্ধেক পারিশ্রমিক দিলেই মহিলা শ্রমিকরা কাজ করতে আগ্রহী হয়। দ্বিতীয়ত, মহিলা শ্রমিকরা কাজ ফেলে গল্প-গুজব করে না। তাদের দিয়ে আদেশ পালন করানো সহজ। তারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কখনও আন্দোলন করে না। মূলত এসব সুবিধার কারণেই তারা বেশি সংখ্যক মহিলা শ্রমিককে কারখানায় নিয়োগ দিয়েছেন। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের অন্যতম দুর্বলতা হচ্ছে আমরা এখানে উপযুক্ত মানবসম্পদের জোগান নিশ্চিত করতে পারিনি। ফলে বিদেশি দক্ষ মানবসম্পদ এখানে কাজ করে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর তারা বেতন-ভাতা বাবদ যে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে তার পরিমাণ ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমতুল্য। আগামীতে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ ক্রমাগত কমে আসবে। তখন দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত লোকবলই হবে উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, আগামীতে মানবসম্পদকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা না করলে টেকসই উন্নয়ন অর্জন করা সম্ভব হবে না। ১৯৯৫ সালে বিশ্বের মোট সম্পদের আর্থিক মূল্য ছিল ৬৯০ লাখ কোটি মার্কিন ডলার, যা ২০১৪ সালে এসে ১ হাজার ১৪৩ লাখ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ বর্ণিত সময়ে সম্পদ বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আর্থিক বৈষম্য। নিম্ন আয়ের দেশের তুলনায় উন্নত দেশগুলোর জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৫২ গুণ।
বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু সম্পদের পরিমাণ হচ্ছে ১২ হাজার ৭১৪ মার্কিন ডলার সমতুল্য ১০ লাখ ১৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে উৎপাদিত সম্পদের বাজার মূল্য ৩ হাজার ৪৩৪ মার্কিন ডলার। প্রাকৃতিক সম্পদের মাথাপিছু পরিমাণ হচ্ছে ২ হাজার ২৩৪ মার্কিন ডলার। চাষযোগ্য জমির আর্থিক মূল্য হচ্ছে ১ হাজার ৫০১ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হলে আমাদের মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। কিন্তু এ দিকে আমাদের তেমন মনোযোগ আছে বলে মনে হয় না। মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য সবার আগে দরকার হলো সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে অমার্জনীয় ব্যর্থতা। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা মানুষের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারছে না। বেকার সৃষ্টি করছে মাত্র। এই শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে আগামী দিনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত মানসম্পন্ন শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
এমএ খালেক
অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক