রোজা পালনের মাধ্যমে মুসলমানরা ‘তাকওয়া’ অর্জন করতে পারে। আর আল্লাহর নিকটবর্তী হতে ‘তাকওয়া’ অর্জনের বিকল্প নেই। তবে অসুস্থতা, সফর বা অন্য কোনো শরয়ি গ্রহণযোগ্য ওজরের দরুন রমজানের যে রোজাগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, সে রোজাগুলো হিসাব করে পরবর্তী কোনো সময়ে রাখাকে কাজা বলা হয়। আর রোজার কাফফারা হলোÑ একটি গোলাম আজাদ করা। আর তা অসম্ভব হলে (যেমন আজকাল গোলাম-বাঁদির প্রচলন নেই) ধারাবাহিকভাবে ৬০টি রোজা রাখা। মাঝখানে যদি একদিনও রোজা ছুটে যায়, তাহলে আবার নতুন করে ৬০টি রোজা রাখতে হবে। আর যদি কেউ ধারাবাহিকভাবে দুই মাসে ৬০টি রোজা রাখতে অক্ষম হয়, তাহলে ৬০ জন মিসকিনকে দুবেলা পেট ভরে খানা খাওয়াতে হবে অথবা প্রত্যেককে এক ফিতরা (যা পৌনে দুই সের অর্থাৎ ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম গম বা তার মূল্য) সদকা করে দেবে।
রোজার ফিদিয়া : ফিদিয়া অর্থ ক্ষতিপূরণ। কোনো ব্যক্তি রোজা রাখতে বা কাজা আদায় করতে অক্ষম হলে তার পরিবর্তে যে সদকা দেওয়া হয়, তাকে ফিদিয়া বলে। (বোখারি, মুসলিম ও মিশকাত শরিফ)।
যেসব কারণে রোজা ভেঙে যায় এবং শুধু কাজা ওয়াজিব হয়
কণ্ঠনালিতে পানি চলে গেলে : অসতর্কতার কারণে গোসল কিংবা অজু করার সময় বা নাকে পানি দেওয়ার সময় যদি কণ্ঠনালিতে পানি চলে যায় এবং সে সময় তার রোজার কথা স্মরণ থাকে, তাহলে ওই ব্যক্তির রোজা ভেঙে যাবে। তবে তার জন্য শুধু কাজা ওয়াজিব হবে। (দুররে মুখতার, খ-২, পৃ. ৪০২)।
মলদ্বারে ওষুধ ব্যবহারের কারণে : রোজাদার ব্যক্তি পায়খানার রাস্তায় ওষুধ প্রবেশ করালে এমনিভাবে কানে বা নাকে ওষুধ দিলে রোজা ভেঙে যাবে এবং তার ওপর শুধু কাজা ওয়াজিব হবে। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া, খ-১, পৃ. ২০৪)।
বাধ্য হয়ে কিছু পানাহার : কোনো রোজাদারকে যদি মেরে ফেলার বা কোনো অঙ্গ ক্ষতিসাধনের হুমকি দিয়ে কিছু আহার বা পানাহার করানো হয়, তাহলে তার রোজা ভেঙে যাবে এবং তার ওপর শুধু ওই দিনের কাজা ওয়াজিব হবে। (বাদাইউস সানাইয়ি, খ-২, পৃ. ৯১)।
রমজানের চাঁদ দেখার পর রোজা ভঙ্গ করা : যদি কোনো ব্যক্তি স্বয়ং রমজানের চাঁদ দেখার পর লোকদের চাঁদ দেখা সম্পর্কে বলল; কিন্তু নেসাবে শাহাদাত না থাকলে তার সাক্ষ্যকে গ্রহণ করা যাবে না। এমতাবস্থায় শুধু তার ওপর রোজা রাখা আবশ্যক। আর যদি সে ওই দিনের রোজা না রাখে তাহলে শুধু তার জন্য ওই দিনের রোজা কাজা দেওয়া ওয়াজিব হবে। (বাদাইউস সানাইয়ি, খ-২, পৃ. ৮৩)।
দাঁতের রক্ত কণ্ঠনালিতে চলে গেলে : রোজাদার ব্যক্তির দাঁত দিয়ে যদি অধিক পরিমাণে রক্ত বের হয়, যা থুতুর পরিমাণ থেকেও বেশি হয় এবং তা কণ্ঠনালির নিচে চলে যায়, তাহলে তার রোজা ভেঙে যাবে। আর যদি রক্তের চেয়ে থুতুর পরিমাণ বেশি হয়, তাহলে রোজা ভাঙবে না। (হিন্দিয়া, খ-১, পৃ. ২০৩)।
রোজা অবস্থায় চনাবুটের চেয়ে বড় কিছু পেটে চলে গেলে : যদি রোজাদার ব্যক্তির দাঁতে চনাবুট বা তার চেয়ে বড় কোনো খাদ্যের টুকরো আটকে থাকে, এ অবস্থায় তা যদি পেটে চলে যায়, তাহলে ওই রোজাদারের রোজা ভেঙে যাবে এবং তার ওপর শুধু ওই রোজার কাজা ওয়াজিব হবে। আর যদি খাদ্য চনাবুট থেকে ছোট হয়, তাহলে তার রোজা ভাঙবে না বটে কিন্তু মাকরুহ হবে। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া, খ-১, পৃ. ২০২)।
কাগজ, লোহা ইত্যাদি যদি ভেতরে চলে যায় : যেসব জিনিস সাধারণত খাদ্য বা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। যেমনÑ কাগজ, লোহা, মাটি, পাথর, কয়লা, গাছ ইত্যাদি আহার করলে বা পানাহার করলে রোজা ভেঙে যাবে এবং ওই ব্যক্তির ওপর শুধু ওই দিনের রোজা কাজা ওয়াজিব হবে। (রদ্দুল মুহতার, খ-২, পৃ. ৪০৩)।
আগরবাতি জ্বালিয়ে ধোঁয়া প্রবেশ : রোজা অবস্থায় আগরবাতি জ্বালিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে মুখে ধোঁয়া প্রবেশ করানোর কারণে রোজা ভেঙে যাবে। কেননা, ওই ব্যক্তি চাইলে ধোঁয়া প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকতে পারত। তাই তার ওপর ওই রোজার কাজা ওয়াজিব হবে। (শামি, খ-২, পৃ. ৩৯৫)।
অসুস্থতা : কোনো রোজাদার ব্যক্তি এমন ভয়ানক রোগে আক্রান্ত হয় যে, অভিজ্ঞ মুসলিম ডাক্তার বা হেকিমের চিকিৎসা মতে যদি সে রোজা রাখে তাহলে তার রোগ বৃদ্ধি পাবে। এমতাবস্থায় ওই ব্যক্তির রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। হ্যাঁ যদি পরে সুস্থ হয়ে যায়, তাহলে ছুটে যাওয়া রোজাগুলো কাজা দেবে। (বাদাইউস সানাইয়ি, খ-২, পৃ. ১০৫)।
অধিক তৃষ্ণার কারণে রোজা ভঙ্গ করলে : যদি কোনো রোজাদার ব্যক্তি অধিক ক্ষুধা বা তৃষ্ণায় পতিত হয়, এমতাবস্থায় সে যদি আহার বা পানাহার না করে, তখন তার মৃত্যুর প্রবল আশঙ্কা থাকে কিংবা পাগল হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা হয়, তাহলে ওই ব্যক্তির জন্য রোজা ভাঙার অনুমতি রয়েছে; কিন্তু পরে সে রোজার কাজা আদায় করবে। আর যদি এমনিতেই সাধারণ ক্ষুধার কারণে রোজা ভেঙে ফেলে, তাহলে তার ওপর ওই রোজার কাজা ও কাফফারা উভয়টা ওয়াজিব হবে। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া, খ-১, পৃ. ২০৫)।
বিদেশের সফর : যদি কোনো রোজাদার ব্যক্তি রোজা শুরু করার পর অন্য দেশে চলে যায় এবং সেখানে নিজের দেশের হিসাব অনুযায়ী আগে ঈদ হয়ে যায়, তখন সে ওই দেশের লোকদের সঙ্গে ঈদ আদায় করে নেবে। অতঃপর ওই রোজাদার ব্যক্তি নিজ দেশীয় হিসাব অনুযায়ী ৩০ দিন থেকে যে ক’টি দিন বাদ গেছে তা পরে কাজা করে নেবে। আর যদি সেখানে নিজের দেশের হিসাব অনুযায়ী দু-একদিন বেড়ে যায়, তখন তাকে অতিরিক্ত রোজা রেখে বিদেশিদের সঙ্গে ঈদ করতে হবে। (বাদাইউস সানাইয়ি, খ-২, পৃ. ৮১)।
যেসব কারণে কাজা-কাফফারা উভয়টা ওয়াজিব হয়
ইচ্ছাকৃত আহার বা স্ত্রীগমন : রমজানের রোজা রেখে দিনের বেলায় শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য কোনো ওজর ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে আহার-পানাহার বা স্ত্রীগমন করলে রোজা ভেঙে যাবে এবং কাজা-কাফফারা উভয়টি ওয়াজিব হবে। (হেদায়া, খ-১, পৃ. ২১৯)।
জানা সত্ত্বেও সুবহে সাদিকের পর স্ত্রীগমন করলে : জানা সত্ত্বেও সুবহে সাদিকের পর পর্যন্ত সহবাসে লিপ্ত থাকলে কাজা-কাফফারা উভয়টা ওয়াজিব হবে। (হিন্দিয়া, খ-১, পৃ. ২০৫)।
রোজা অবস্থায় ধূমপান করলে : যদি রমজানের রোজা রাখা অবস্থায় বিড়ি-সিগারেট বা হুক্কা পান করে, তাহলে তার ওপর ওই রোজার কাজা ও কাফফারা উভয়টা ওয়াজিব হবে। (ফতোয়ায়ে শামি-৩/৩৬৬)।
জোরপূর্বক স্ত্রীগমন করলে : যদি কোনো স্বামী জোরপূর্বকভাবে সহবাস করে অথবা স্ত্রী জোরপূর্বকভাবে স্বামীর সঙ্গে সহবাস করে, তাহলে উভয়ের রোজা নষ্ট হয়ে যাবে। তবে এতে যার ওপর জবরদস্তি করা হয়েছে তার ওপর শুধু কাজা ওয়াজিব হবে। আর যে জবরদস্তি করেছে তার ওপর কাজা-কাফফারা উভয়টি ওয়াজিব হবে। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া, খ-২, পৃ. ২০৪)।
রোজা ভেঙে গেছে মনে করে রোজা ভেঙে দিলে : রোজাদার ব্যক্তির শরীরে তৈল বা সুরমা লাগানোর কারণে রোজা ভাঙে না। কিন্তু যদি কেউ রোজা ভেঙে গেছে মনে করে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার বা স্ত্রী সহবাস করে ফেলে, তাহলে তার ওপর ওই রোজার কাজা-কাফফারা উভয়টা ওয়াজিব হবে। (দুররে মুখতার, খ-২, পৃ. ৪১৭)।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক জামিয়া বায়তুল করিম চট্টগ্রাম