আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ৯-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

মদিনা শরিফের জুমার খুতবা

রহমত ও ক্ষমার মাস রমজানকে কাজে লাগান

শায়খ ড. আবদুল মুহসিন বিন মুহাম্মাদ আল-কাসেম
| নবী জীবন

কোরআন আল্লাহর কালাম। বান্দার কাছে তা আল্লাহর দলিল। কোরআন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উৎস। কোরআন রেসালতের নিদর্শন। কোরআন ছাড়া আল্লাহকে চেনার পথ নেই, তা ছাড়া মুক্তি নেই আমাদের। কোরআন চোখ ও অন্তরের আলো। যে এর কাছে আসে, সে সম্মানিত হয়। কোরআন তেলাওয়াতে আছে বিশাল পুণ্য ও প্রতিদান। তা অধ্যয়ন করলে অর্জিত হয় ইলম ও দৃঢ়তা। এ অনুসারে আমল করলে তা হয় দুর্গ ও নিরাপত্তা

দিন ও রাতগুলো দ্রুততালে চলে যায়। বছর তার মাসগুলোকে ধারাবাহিকভাবে গুটিয়ে নেয়। বান্দারা এরই মাঝে আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়। শিগগিরই তারা নিজেদের আমলগুলোর সাক্ষাৎ পাবে। আল্লাহর অন্যতম অনুগ্রহ ও দয়া হলো, তিনি তাদের জন্য বছরের সময়গুলোতে ইবাদত-বন্দেগির কিছু মৌসুম নির্বাচন করেছেন। এমন কিছু দিন, রাত ও মুহূর্ত বাছাই করেছেন, যেখানে আগ্রহ-উদ্দীপনা বেড়ে যায়, প্রস্তুতি বৃদ্ধি পায়। প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতা করে।
যখনই রমজানের নতুন চাঁদ উদিত হয়, তা আমাদের কাছে আবার নিয়ে আসে বরকতময় সুবাস ও সুগন্ধি। মুসলিমরা মনের আনন্দে তাকে স্বাগত জানায়। রমজানের খুশিতে তাদের হৃদয় ভরে যায়। রমজান মাসে বান্দা কবুল ও গ্রহণযোগ্যতার এমন কিছু মুহূর্তের নাগাল পায় যার দ্বারা সে সৌভাগ্য ও সন্তোষপ্রাপ্তির উচ্চস্তরে পৌঁছে।
সবচেয়ে পবিত্রতম ও মর্যাদাবান মাসটি আমাদের কাছে আগমন করেছে। মহান একটি মাস যাকে আল্লাহ সম্মান ও মর্যাদায় বিশেষভাবে ভূষিত করেছেন। এ মাসে আল্লাহ রাসুলুল্লাহ (সা.) কে রাসুল হিসেবে প্রেরণ করেছেন, তাঁর কিতাব নাজিল করেছেন, রমজানের রোজা ফরজ করেছেন। এ মাসের মুহূর্তগুলো বরকতময়। সময়গুলো কল্যাণে ভরপুর। এ মাসে কল্যাণ ও বরকতের ফল্গুধারা বইতে থাকে। এটা দানখয়রাত ও দয়ার মৌসুম। পাপ মোচন ও ক্ষমার সময়। দিনের বেলা রোজা আর রাতের বেলা জেগে থেকে ইবাদত। নামাজ ও কোরআন তেলাওয়াতে জীবন্ত থাকে এ মাস।
এ মাসে জান্নাতের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়, জাহান্নামের প্রবেশপথ বন্ধ করা হয়। শয়তানদের বেঁধে রাখা হয়। এ মাসে এমন একটি রজনি আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এ রজনির কল্যাণ থেকে যে বঞ্চিত হয়, সে প্রকৃত হতভাগা ও নিঃস্ব।
রমজান মাস হলো ইবাদত-বন্দেগির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করার বিরাট ময়দান। মনকে বিভিন্ন কলুষতা ও সংকট থেকে পবিত্র করার একটি সুযোগ। এ পবিত্র মাসে আমলের প্রতিদান বহুগুণে বাড়ানো হয়। গোনাহ ও পাপ হ্রাস করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুমা থেকে আরেক জুমা ও এক রমজান থেকে আরেক রমজান তাদের মধ্যবর্তী পাপগুলোকে মোচনকারী, যদি কবিরা গোনাহগুলো থেকে বিরত থাকা হয়।’ (মুসলিম)। এ মাসে মুসলিম সমাজ সম্মিলিতভাবে ইসলামের একটি স্তম্ভ বা রুকন আদায় করে, যা এ ধর্মের মহত্ত্বের বাহ্যিক একটি ব্যবহারিক দিক। মুসলিমদের ঐক্যের প্রতীক। যেখানে আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীটি ভাস্বর হয়ে ওঠে : ‘নিশ্চয়ই তোমরা একটি একক অভিন্ন উম্মাহ, আর আমি তোমাদের রব; তাই আমার ইবাদত কর।’ (সূরা আম্বিয়া : ৯২)।
কল্যাণের মৌসুমগুলোকে কাজে লাগানো আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি উন্মুক্ত উপহার। রমজান মাসে মুসলমানদের জন্য ইবাদতের মৌলিক ও বৃহত্তম বিষয়গুলোর সমাবেশ ঘটে। যেমনÑ নামাজ বান্দা ও রবের মাঝে সেতুবন্ধন। মুসলিমের গোটা জীবনেই নামাজ কখনও তার থেকে আলাদা হয় নয়। পুরুষের জন্য জামাতে নামাজ আদায় আবশ্যক। জামাতে নামাজ আদায় করা বাড়িতে ও বাজারে নামাজ পড়ার তুলনায় ৭০ গুণ সমান।
মুসলিমের উচিত রোজার মাধ্যমে সে নামাজের জন্য সহযোগিতা নেবে। আর নামাজের সিংহভাগটা রাতের বেলায় হবে। ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও পুণ্য লাভের আশায় রমজানে রাত জেগে ইবাদত করে তার আগের পাপগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (বোখারি ও মুসলিম)। ‘যে ব্যক্তি ইমামের সঙ্গে তার প্রস্থান পর্যন্ত রাত জেগে ইবাদত করে তার জন্য পুরো রাত জাগার পুণ্য ধার্য করা হয়।’ (তিরমিজি)।
জাকাত ও দানখয়রাত সম্পদের জন্য পবিত্রতা ও বৃদ্ধির উপায়। মনের পরিশুদ্ধি ও প্রাচুর্য। জাকাতের প্রভাব অন্তর, সম্পদ ও সন্তানের ওপর প্রকাশ পায়। তা বিপদ দূর করে ও সচ্ছলতা আনে। যে ব্যক্তি আল্লাহর বান্দাদের জন্য দয়াশীল হয় আল্লাহ তার জন্য সদয় হন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ বলেছেন, হে আদম সন্তান, তুমি খরচ কর, আমিও তোমার জন্য খরচ করব।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
কেয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের দানখয়রাতের ছায়ায় আশ্রয় পাবে। তাই দান করুন, অল্প হলেও। দান করে মনের দিক দিয়ে ভালো থাকুন, দানের মাধ্যমে বঞ্চিতকে অভয় দিন। যে কোনো রোজাদারকে ইফতার করায় সে তার রোজার সমপরিমাণ প্রতিদান পায়। রাসুলের নীতি ছিল দান ও দয়া করা। তিনি ওই লোকের মতো দান করতেন, যে দারিদ্র্য ভয় পায় না। তিনি দান করলে প্রচুর দিতেন। কোনো প্রার্থীকে ফিরিয়ে দিতেন না। তাঁর কাছে কিছু চাইলে তিনি না দিয়ে থাকতেন না। রমজান মাসে রাসুলুল্লাহ (সা.) সবচেয়ে বেশি দান করতেন। এ মাসে তিনি খোলা বাতাসের চেয়েও বেশি দানশীল হতেন।
রোজা এ মর্যাদাশীল মাসের সবচেয়ে বড় পরিচয়। এতে মুসলমানদের তাকওয়া বৃদ্ধি পায়। ‘হে ঈমানদাররা, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার।’ (সূরা বাকারা : ১৮৩)। রোজার সওয়াব অসংখ্য-অগণিত। আল্লাহ হাদিসে কুদসিতে বলেন, ‘আদম সন্তানের প্রত্যেক আমল তার নিজের জন্য; তবে রোজা ছাড়া। কেননা তা আমার জন্য, আর আমি নিজে তার প্রতিদান দেব।’ (বোখারি ও মুসলিম)। ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে পুণ্য লাভের আশায় রমজানের রোজা রাখে তার পূর্ববর্তী গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (বোখারি ও মুসলিম)। রোজা হলো রোজাদার ও যাবতীয় অনিষ্ট ও পাপাচারের মাঝে প্রতিবন্ধক। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেনÑ ‘রোজা ঢালস্বরূপ।’ (তিরমিজি)।
রমজানে ওমরা আদায় করা অন্যতম একটি গনিমততুল্য সৎকর্ম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রমজান মাসের একটি ওমরা একটি হজের সমান।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
কোরআন আল্লাহর কালাম। বান্দার কাছে তা আল্লাহর দলিল। কোরআন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উৎস। কোরআন রেসালতের নিদর্শন। কোরআন ছাড়া আল্লাহকে চেনার পথ নেই, তা ছাড়া মুক্তি নেই আমাদের। কোরআন চোখ ও অন্তরের আলো। যে এর কাছে আসে, সে সম্মানিত হয়। কোরআন তেলাওয়াতে আছে বিশাল পুণ্য ও প্রতিদান। তা অধ্যয়ন করলে অর্জিত হয় ইলম ও দৃঢ়তা। এ অনুসারে আমল করলে তা হয় দুর্গ ও নিরাপত্তা। কোরআনের শিক্ষা ও এর প্রতি দাওয়াত দেওয়া সৎলোকদের মাথার তাজ। রমজান মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে। তাই এ মাসে বেশি বেশি কোরআন পাঠ করা, তা নিয়ে চিন্তা করা, শেখা, শেখানো, সে অনুযায়ী আমল করা ও মানা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘রমজান মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কোরআন মানুষের হেদায়েতের জন্য, তা হেদায়েতের সুস্পষ্ট দলিল ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)।
জিবরাইল (আ.) প্রতি বছর রমজান মাসে একবার করে আমাদের নবী রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে কোরআনের পাঠ-পর্যালোচনা করতেন। আর যে বছর তিনি মারা যান, সে বছর দুবার পাঠ করেছিলেন।
দোয়া একটি ইবাদত ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়। এটা কষ্টহীন গনিমত ও প্রাপ্তি। দোয়া এমন লাভজনক, যাতে কোনো লোকসান ও দুর্ভাগ্য নেই। দোয়া সচ্ছলতা নিয়ে আসে আর বিপদ দূর করে। দোয়া করে কেউ ধ্বংস হবে না কখনও। দোয়ার দ্বারা বান্দা তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। শেষ রাতের দোয়া সবচেয়ে বেশি কবুল হয়।
রোজাদারের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। ইবনে রজব (রহ.) বলেছেন, ‘রোজাদার দিবসে ও রাতে ইবাদতের মাঝে থাকে। রোজা থাকাকালীন ও ইফতার অবস্থায় তার দোয়া কবুল করা হয়। দিনের বেলা সে ধৈর্যশীল রোজাদার আর রাতে শোকরগুজার আহারকারী।’ সুতরাং সে লোকই সফল ও সৌভাগ্যবান, যে আসমানের দুয়ারে করাঘাত করে এবং নিজের জন্য এ দিনগুলো ও রাতগুলো থেকে সঞ্চয় করে নেয়।
আল্লাহর জিকির করা একটি সহজ মহান ইবাদত। যে আল্লাহকে স্মরণ করে আল্লাহ তাকে স্মরণ করে। ইবাদতের পূর্ণতা হলো সেটাকে এমন জিনিস থেকে রক্ষা করা, যা তার মধ্যে ত্রুটি সৃষ্টি করে বা নষ্ট করে দেয়। তাই রোজাদার তার ইবাদতকে এসব বিনষ্টকর বিষয় থেকে রক্ষা করতে খুব বেশি সচেষ্ট থাকবে।

২৯ শাবান ১৪৪০ হিজরি মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর 
মাহমুদুল হাসান জুনাইদ