খুলনা-যশোর অঞ্চলের ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে শ্রমিকের বেতন বকেয়া রয়েছে ৫৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর এ বকেয়া মজুরিসহ ৯ দফা দাবিতে আন্দোলনে রয়েছেন শ্রমিকরা। অন্যদিকে বিজেএমসি বলছে, অর্থ বরাদ্দ না থাকায় শ্রমিকের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না। বকেয়া মজুরিসহ ৯ দফা দাবিতে ৯ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে উৎপাদন বন্ধ করেন শ্রমিকরা। একই সঙ্গে প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে রাস্তায় ইফতার করেন তারা। এদিকে, ১৩ মে থেকে সারা দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। বুধবার দুপুরে ঢাকার বিজেএমসির সিবিএ কার্যালয়ে পাটকল শ্রমিক লীগ ও সিবিএ ও নন-সিবিএ’র বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত রাজপথ-রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
মো. আবদুর রাজ্জাক, প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলের মেশিনম্যান। গেল ১১ সপ্তাহ ধরে মজুরি পান না। বকেয়া মজুরির দাবিতে চলছে
শ্রমিকদের আন্দোলন, তাই মিলও বন্ধ। পেটের দায়ে সংসার চালাতে ইজি বাইক চালাচ্ছেন তিনি। মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, আমি বদলি শ্রমিক। দীর্ঘদিন ধরে কোনো কাজ পাই না, তার পর মজুরি বকেয়া রয়েছে। এ কারণেই ইজিবাইক চালাচ্ছি। একই রকম অবস্থা খুলনা-যশোর অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলের। ৮ সপ্তাহ থেকে ১১ সপ্তাহের বেতন না পেয়ে নিদারুণ জীবন পার করছেন তারা।
৫০-এর ঊর্ধ্বে বয়স শ্রমিক পান্নু মিঞা বলেন, আমি হৃদরোগে আক্রান্ত। আমার প্রতিদিন ৫১২ টাকার ওষুধ লাগে। কিন্তু গেল তিন দিন ধরে ওষুধ কিনতে পারছি না। প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলের ওয়ার্কসপে কাজ করেন মো. খোকন। তিনি বলেন, মানুষের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে ধার করে চলছি। দোকানদার এখন আর বাকি দেন না। তিনি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘এর থেকে আমাদের বিষ এনে দেন। আমরা খেয়ে মরি’। পরিবারের খরচ না চালাতে পারায় আমাদের মরার মতো অবস্থা। আমাদের মজুরি দিতে যদি এত সমস্যা হয়, তাহলে মিল বন্ধ করে আমাদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ করলেই তো হয়।
শ্রমিক নেতারা বলেন, গেল দুই মাসে বেশ কয়েকবার কর্মবিরতি ও টানা রেল ও সড়ক পথ আবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। সে সময় শ্রম অধিদপ্তর, বিজেএমসি ও শ্রমিক নেতাদের তৃপক্ষীয় সভায় আশ্বাস দেওয়া হয় ২৫ এপ্রিলের মধ্যে বকেয়া মজুরি দেওয়া হবে ও চালু করা হবে মজুরি কমিশন। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। এ কারণেই শ্রমিকরা পেটের ক্ষুধায় মিল বন্ধ করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ পাটকল শ্রমিক সিবিএ-নন সিবিএ ঐক্য পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. খলিলুর রহমান বলেন, শ্রমিক কর্মবিরতি চলার পাশাপাশি সড়ক ও রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করছি। তিনি বলেন, বুধবার দুপুরে ঢাকার বিজেএমসির সিবিএ কার্যালয়ে পাটকল শ্রমিক লীগ ও সিবিএ ও নন-সিবিএ’র বৈঠকে ১৩ মে থেকে সারা দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত রাজপথ-রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
খুলনার ৯ পাটকলে বকেয়া ৫৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা : খুলনার ৯ পাটকলে বকেয়া রয়েছে ৫৮ কোটি ৭০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর মধ্যে আলীম জুট মিলে বকেয়া রয়েছে ১১ সপ্তাহের ৩ কোটি ৮১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা, কার্পেটিং জুট মিলে ৮ সপ্তাহের টাকা ১ কোটি ৫৭ লাখ ২০ হাজার টাকা, ক্রিসেন্ট জুট মিলে ১১ সপ্তাহের ১৩ কোটি ৪৭ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, দৌলতপুর জুট মিলে ৮ সপ্তাহের ১ কোটি ১২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা, ইস্টার্ন জুট মিলে ১১ সপ্তাহের ৪ কোটি ৮১ লাখ ১১ হাজার টাকা, জেজেআই জুট মিলে ১১ সপ্তাহের ৭ কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, খালিশপুর জুট মিলে ৮ সপ্তাহের ৫ কোটি টাকা, প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলে ১১ সপ্তাহের মজুরি ১২ কোটি ২৩ লাখ ১ হাজার টাকা, স্টার জুট মিলে মজুরি ১১ সপ্তাহের ৯ কোটি ২৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকা।
সূত্র মতে, খুলনার ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে কাজ করেন ৩০ হাজার ৫৮২ শ্রমিক, যার মধ্যে স্থায়ী শ্রমিক ১৩ হাজার ১৭০ ও অস্থায়ী শ্রমিক ১৭ হাজার ১৭০।
বিজেএমসি, খুলনার আঞ্চলিক কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ শেখ বলেন, অর্থ পাওয়া মাত্রই শ্রমিকের বকেয়া পরিশোধ করা হবে। চুক্তির পর অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় আমরা শ্রমিকের বেতন দিতে পারছি না। বর্তমান পরিস্থিতি আমরা কেন্দ্রে জানিয়েছি।
উল্লেখ্য, ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বকেয়া মজুরিসহ ৯ দফা দাবিতে লাল পাতাকা মিছিল, গেট সভা, লাঠি মিছিল, ভুখা মিছিল, কর্মবিরতি ও অবরোধ পালন করে আসছেন শ্রমিকরা। প্রতিবার তাদের আশ্বাস দিয়ে কাজে ফেরালেও আশ্বাসের বাস্তবায়ন হচ্ছে না।