আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ৯-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

দেওয়াল কথা বলে

সাজ্জাদ মাহমুদ খান
| প্রথম পাতা

- রাজধানীতে প্রতিদিন লাগানো হয় ২৫ হাজার পোস্টার; কাজ করে অর্ধশত গ্রুপ
- সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত স্থান ফাঁকা
- সচেতনতায় কাজে লাগাতে পারে সরকার

চোখ দেখেই যেমন ভেতরটা আন্দাজ করা যায়, তেমনি একটি শহরের পথের ধারের দেওয়ালগুলো তুলে ধরে ওই এলাকার মানুষের প্রতিচ্ছবি। দেওয়ালের লেখা-আঁকা তুলে ধরে রুচি, নান্দনিকতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির। দেওয়াল কখনও হয়ে উঠে শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার, কখনও পণ্যের বিজ্ঞাপন কিংবা ভালোবাসার আঁকিবুকি। দেওয়ালে ইটপাথরে ভেসে থাকে ভালোবাসার অক্ষর। ইতিহাস আর দেশের মহান মানুষদের জানতে পারি দেওয়াল থেকে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অভিজাত এলাকার ভবন এবং কিছু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দেওয়াল ছাড়া ঢাকার শহরের বেশিরভাগ দেওয়ালই টু-লেট, পড়াতেই চাই আর কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপনের ফাটা-ছেঁড়া পোস্টারে ঠাসা। 

সংশ্লিষ্টরা বলেন, পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যবহার করলে শহরের পথের দুই পাশের দেওয়াল হতে পারে অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বিজ্ঞাপন। দেওয়ালের তুলির আঁচড়ে উঠে আসতে পারে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা এবং সংস্কৃতির ছবি। দেওয়ালই হতে পারে উদারতা, মানবিকতা ও সততার বই। ঢাকা সিটির করপোরেশন (উত্তর) সাবেক মেয়র আনিসুল হক দেওয়ালের পরিচ্ছন্নতা ও নান্দনিকতার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও বর্তমানে তা থমকে গেছে। 

তবে কিছু প্রতিষ্ঠান দেওয়ালে তাদের কর্মকা-ের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তুলে ধরছে বিভিন্ন মনীষীর প্রেরণামূলক বিভিন্ন উক্তি। রাজধানীর লালমাটিয়ার হাউজিং সোসাইটির দেওয়ালজুড়ে বিভিন্ন মনীষীর উদ্দীপ্তমূলক বাণী আর নানা রঙের আঁকাআঁকি। স্কুলের দেওয়ালে রয়েছে পল্লীকবি জসীমউদ্দীন উক্তি-বই জ্ঞানের প্রতীক, বই আনন্দের প্রতীক। অপরাধের বিরুদ্ধে সচেতনা সৃষ্টিতে দেওয়ালজুড়ে লেখা শোভা পাচ্ছেÑ ‘সন্ত্রাস, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও মাদককে না বলুন’। ধর্মীয় বাণীও শোভা পাচ্ছে কিছু প্রতিষ্ঠানের দেওয়ালে। শুক্রবাদের নিউ মডেল বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে হাদিসের বাণী ‘সর্বোত্তম দোয়া আলহামদুলিল্লাহ’। আবার রমনা পার্কের পাশের একটি দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে বীরশ্রেষ্ঠদের প্রতিকৃতি। শুক্রবার পার্কে আসা নাজিমউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি দেওয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে থাকা শিশুটির কাছে (ভাগিনা) বীরশ্রেষ্ঠদের পরিচিত তুলে ধরছে। এভাবে চলতি পথে দেওয়ালে চোখ বুলিয়ে শিশু-কিশোর থেকে সব শ্রেণির মানুষই মনীষীদের প্রেরণামূলক বাণী থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারছে। 
তবে রাজধানীর অল্প কিছু দেওয়ালে শিক্ষা আর সংস্কৃতির লেখা এবং আঁকাআঁকি থাকলেও অধিকাংশ দেওয়ালই নোংরা আর ছেঁড়া-ফাটা বিজ্ঞাপনের পোস্টারে ভরা। স্কুল-কলেজের আশপাশের দেয়ালগুলোয় ‘পড়াতে চাই’ কিংবা কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপনে ভর্তি। এসব এলাকার বাড়ির মালিকরা চেষ্টা করে কিংবা পাহারা লাগিয়েও দেওয়ালে বিজ্ঞাপনের লেখা কিংবা পোস্টার বন্ধ করতে পারেন না। ফার্মগেট এবং এর আশপাশের প্রতিটি দেওয়ালে সাদাকালো বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে ভরা। কোনোটিতে কোচিংয়ের বিজ্ঞাপন, কোনোটিতে টু-লেট আবার কোনোটিতে টিউশনির বিজ্ঞাপন। একটি বিজ্ঞাপন লাগিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর তার ওপর আরেকটি বিজ্ঞাপন লাগিয়ে দেওয়া হয়। দেওয়ালগুলোয় বিজ্ঞাপনের কয়েকটি স্তর সৃষ্টি হয়। 
বাসাবো থেকে কমলাপুর টিটিপাড়া পর্যন্ত রাস্তার বাম পাশে ফুটপাত ঘেঁষে রেলওয়ের দেওয়াল। প্রায় ১ কিলোমিটারের বেশি ছেঁড়া-ফাটা পোস্টারে কোনো জায়গাও ফাঁকা নেই। পুরো অংশজুড়েই বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন। দাঁতের চিকিৎসা, যৌন চিকিৎসা, হোমিও চিকিৎসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সব ধরনের পণ্যের বিজ্ঞাপন রয়েছে। বেশিরভাগই হাতে লেখা, আছে পোস্টারও। রেহাই পায়নি পার্শ্ববর্তী শাজাহানপুর কবরস্থানের দেওয়ালও। বাড়ির ভাড়ার পোস্টারও কবরস্থানের গায়ে। পুরো মৌচাক এলাকাজুড়ে আছে কোচিং সেন্টার, দন্ত চিকিৎসা, সিনেমার পোস্টারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতার প্রচারণা। 
ফার্মগেটের তেজতুরি বাজারের বাড়ির মালিক মামুন মিয়া জানান, বাড়ির বাউন্ডারি দেওয়ালে রং করে এরপর লিখে দেওয়া হয়েছে ‘দেওয়ালে লেখা ও পোস্টার লাগানো নিষেধ’। কিন্তু কে শোনে এ নিষেধ। দিনের বেলায় পাহারা দিয়ে রাখলেও রাতে এসে পোস্টার লাগিয়ে যায়। ইচ্ছা থাকলেও দেওয়ালে সৌন্দর্য ধরে রাখা যাচ্ছে না। 
মিরপুরের টোলারবাগের বাসিন্দা মুজিবুল ইসলাম বলেন, শুধু আইন দিয়ে অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে না। মনমানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। আইনের প্রয়োগও থাকতে হবে। আমরা এ শহরে বসবাস করি। এ শহর সুন্দর রাখার দায়িত্ব আমাদের। আমাদের বোধের পরিবর্তন হলে শহর সুন্দর হবে ও দেওয়ালই ওই এলাকার মানসিকতার পরিচয় তুলে ধরবে। 
তবে উত্তরা গুলশান ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকায় ঝকঝকে তকতকে। এসব এলাকার দেওয়ালগুলো তাদের আভিজাত্য অর্থবিত্তের প্রকাশ করে। কিছু বাড়ির দেওয়াল নান্দনিকতায় সাজানো। এদিকে পুরোনো ঢাকার অধিকাংশ দেওয়াল পলেস্তারা খসে পড়া কিংবা শেওলা পড়া। কিছু দেওয়ালে বিজ্ঞাপনের লেখা আঁকা থাকলেও অধিকাংশ দেওয়ালই নোংরা। দেওয়ালের পাশে ময়লার স্তূপ দেখা যায়। কিছু দেওয়ালে পাশে মলমূত্রের দুর্গন্ধও পাওয়া যায়। 
জানা গেছে, দেওয়ালে পোস্টার লাগানোর জন্য রাজধানীতে অন্তত ৫০টি গ্রুপ আছে। বিভিন্ন গ্রুপ টাকার বিনিময়ে কোচিং সেন্টারসহ অন্যান্য সংস্থা পোস্টার লাগিয়ে দেয়। প্রতিটি গ্রুপ প্রতি রাতে প্রায় ৫০০টি পোস্টার দেওয়ালে লাগায়। সেই হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ২৫ হাজার পোস্টার রাজধানীর দেওয়ালে নতুন করে লাগানো হয়। ফার্মগেট এলাকায় পোস্টার লাগানোর কর্মী সোহেল জানান, রাতে তারা বিভিন্ন এলাকায় পোস্টার লাগান। পোস্টারের সাইজ অনুযায়ী টাকা নিয়ে থাকি। 
নগর বিশেষজ্ঞরা বলেন, নগরে সৌন্দর্য বর্ধন ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়মিত তদারকির বিষয়। নগরীতে ইচ্ছামতো দেওয়াল লিখন বা পোস্টার সাঁটালে স্থাপনার সৌন্দর্য নষ্ট হয়। অপরিচ্ছন্ন হয় নগর। রাজধানী ঢাকা শহরেও এরকম আইন রয়েছে। কিন্তু যথাযথ প্রয়োগ ও প্রচারের অভাবে নাগরিকরা আইন সম্পর্কে সচেতন নন। শহর ঘুরে দেখলে মনে হবে পুরোটাই যেন বিজ্ঞাপনের নগরী। এ বিষয়ে সচেতনতার পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগ করার কোনো বিকল্প নেই। সিটি করপোরেশনের ঘোষণা দেওয়া বোর্ডের বাইরে কেউ পোস্টার লাগালে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
২০১২ সালে দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণ আইন গেজেট আকারে প্রকাশ করে সরকার। আইন অনুযায়ী নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য কোনো দেওয়ালে বা স্থানে পোস্টার লাগানো নিষেধ। আইন ভঙ্গ করলে ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনধিক ৩০ দিন পর্যন্ত কারাদ- দেওয়া যাবে। তবে এ আইনের তোয়াক্কা না করে পোস্টার লাগানো হচ্ছে যত্রতত্র। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপক কমোডর আবদুর রাজ্জাক বলেন, পোস্টার লাগানোর জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) নির্ধারিত জায়গা রয়েছে। তার পরও মানুষ ইচ্ছামতো যেখানে সেখানে পোস্টার লাগান। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করি নগর পরিচ্ছন্ন রাখার।
নির্ধারিত স্থানে পোস্টার লাগানো হয় না : রাজধানীর যেখানে সেখানে পোস্টার লাগানো থেকে বিরত রাখতে অন্তত ২০টি স্থানে বোর্ড স্থাপন করে সেখানে পোস্টার লাগাতে বলছে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য বিভাগ। গুলশান শুটিং ক্লাব, খামারবাড়ি, উত্তরা, মিরপুর, মহাখালী, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর এলাকায় বিলবোর্ডগুলো লাগানো হয়। রাজধানীর আসাদগেট, মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সেন্টার, মানিক মিয়া এভিনিউয়ে টিঅ্যান্ডটি মাঠের পাশে, মিরপুর টোলারবাগ আবাসিক এলাকা, মিরপুর-১ রাইনখোলা মোড়সহ ডিএনসিসির পোস্টার লাগানোর স্ট্যান্ডগুলো খালি পড়ে আছে। যত্রতত্র পোস্টার লাগানোর অপরাধে জরিমানা করেও নির্ধারিত স্থানে পোস্টার লাগানোর অভ্যাস তৈরি করা যাচ্ছে না। তবে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলেন, মেয়র আনিসুল হক যত্রতত্র পোস্টার লাগানো বন্ধ করতে এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার পর এ বিষয়টি যথাযথভাবে তদারকি না থাকার কারণে আবার ছেঁড়া-ফাটা পোস্টার ব্যানারে দেওয়াল ছেয়ে যাচ্ছে। 
দেওয়ালের সৌন্দর্য বর্ধনে শিক্ষার্থীরা : রাজধানীর তেজগাঁও রেলক্রসিং থেকে সাতরাস্তা মোড় পর্যন্ত মেয়র আনিসুল হক সড়কের দুই পাশের দেওয়াল হাতে আঁকা চিত্র দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ১৮০ শিক্ষার্থী কাজ করেন। সম্প্রতি দেওয়ালে নানা ধরনের প্রতিকৃতি ও দেওয়াল লিখন করে নতুন রূপে সাজানো হচ্ছে সড়কের পাশের দেওয়াল। এছাড়া শিক্ষা, শিশু অধিকার, শিশু নির্যাতন, বাল্যবিয়ে, লিঙ্গবৈষম্য, যৌন হয়রানি বা ইভটিজিং, ধর্মীয় বৈষম্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) একদল শিক্ষার্থী। তারা দেওয়াল লিখনের মাধ্যমে এসব বিষয়ে সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন, যার মাধ্যমে তারা তুলে ধরতে চেষ্টা করেন সমাজের বিভিন্ন সমস্যা ও উত্তরণের উপায়। 
বৈষম্যের কথা বলে দেওয়াল : ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চলেছে সেøাগানের দেওয়াল লিখন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ১৯৬৮ সালে একটি দেওয়াল লিখন সবাইকে আকৃষ্ট করেছিল ‘আইয়ুব-মোনায়েম দুই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই’। একই সময় দেওয়ালে লেখা থাকত ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।’ বর্তমানে দেওয়াল লিখনের পাশাপাশি গ্রাফিতির মাধ্যমে সমাজের অসংগতি তুলে ধরা হচ্ছে। ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা’ বর্তমানে গ্রাফিতি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। শিল্পির তুলির আঁচড়ে তুলে ধরা হচ্ছে সমাজ রাষ্ট্রের অবস্থা।