- ভেঙে পড়েছে বিকল্প ব্যবস্থাও
- টেকেনি সমবায় বাজার উদ্যোগ
- সিন্ডিকেটের কব্জায় বাজার
বাজার ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা নেই। ভেঙে পড়েছে শক্তিশালী বিকল্প বাজার ব্যবস্থা। স্বাধীনতা-পরবর্তী নানা উদ্যোগ থাকলেও তা এখন নিষ্ক্রিয়। টেকেনি সমবায় বাজার উদ্যোগও। নিভু নিভু কার্যক্রম পরিচালনা করছে টিসিবি, কিন্তু দামের ক্ষেত্রে বাজারে তেমন প্রভাব নেই। সুযোগ বুঝে একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে সিন্ডিকেট। ইচ্ছেমতো হাঁকানো হচ্ছে দাম; আর ক্রেতার বাড়ছে নাভিশ্বাস।
কসকোর, সমবায় মার্কেটিং সোসাইটি এবং সর্বশেষ টিসিবি। মুক্তবাজার অর্থনীতির মডেল ধারণায় ভেস্তে গেছে এসব উদ্যোগ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সরকারের হাত। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছা করলেই পণ্যের দাম বাড়ানো সম্ভব ছিল না। তখন ডিলারের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় পণ্য বিক্রি করত সরকার। সাবান থেকে শুরু করে চাল, ডাল, আটাসহ বিভিন্ন পণ্য বিদেশ থেকে সরকারিভাবে আমদানি করে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের কাছে বিক্রি করা হতো। কিন্তু এখন বাজারে সংকট হলেও বিকল্প সরবরাহ ব্যবস্থা নেই।
কসকোর এবং টিসিবির সৃষ্টি : দেশে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কসকোর’ অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ কনজুমার সাপ্লাই করপোরেশন’। সে সময় এ প্রতিষ্ঠানে লোকবল ছিল ২২ হাজারের বেশি। সরকার সে সময় কসকোর মাধ্যমে পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নেয়। মানুষের মধ্যে আরও সহজে পণ্য পৌঁছে দিতে ১৯৭৩ সাল থেকে পুরোদমে কাজ শুরু করে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। যদিও টিসিবি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকারের সময়। তখন এর নাম ছিল ‘ট্রেডিং করপোরেশন অব পাকিস্তান অর্থাৎ টিসিপি’। স্বাধীনতার পর টিসিবির মাধ্যমে সরকার বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে শুরু করে। আর সেসব আমদানিকৃত পণ্য ডিলারের মাধ্যমে বিক্রি করতো কসকোর। পাশাপাশি টিসিবিও নিজস্ব ডিলার নিয়োগ করে পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নেয়। এসবই ছিল সরকারি উদ্যোগ। সে সময় টিসিবির মোট জনবল ছিল ১ হাজার ২০০। আর দেশব্যাপী ডিলার ছিল প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার। টিসিবির কার্যক্রম শুরু হওয়ার পরপরই শুরু করা হয়Ñ ‘সমবায় মার্কেটিং সোসাইটি’র। এটিও ছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান। টিসিবির কাছ থেকে পণ্য নিয়ে তারা বিক্রি করত।
টিসিবির নিয়ন্ত্রণ : সরকারি এমন উদ্যোগের প্রথম ধাক্কা লাগে ১৯৮৫ সালে। তখন কসকোর ও সমবায় সোসাইটি বন্ধ করে দেয়া হয়, চালু থাকে শুধু টিসিবি। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। প্রতিষ্ঠানটিতে শুরুর সময় জনবল ছিল ৮৩১ জন। পরবর্তীতে এর কার্যক্রম জোরদার করার জন্য ১৯৮৪ সালে এর জনবল ১ হাজার ৩৩৬ জনে উন্নীত করা হয়। তবে ১৯৯২ সালে এক আদেশের মাধ্যমে টিসিবিতে সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর অবসরগ্রহণ, শূন্য পদে নিয়োগ বন্ধ থাকা এবং সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে ১৯৯৬ সালে সংকুচিত হয় টিসিবি। তখন একজন চেয়ারম্যান ও তিনজন পরিচালক নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের মোট জনবল দাঁড়ায় ৭১৪ জনে। সর্বশেষ ২০০২ সালের অক্টোবরে ৩৪০ জনকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে টিসিবি কর্মকর্তা-কর্মচারী শূন্য করা হয়। তখন এর মোট জনবল দাঁড়ায় ২৩৫ জনে। তারপর থেকে তেমন লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। সর্বশেষ এখন এর জনবল ১৭৫ জন।
থমকে গেছে সমবায় বাজার উদ্যোগ : অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের কবল থেকে উৎপাদক সমবায়ী ও ভোক্তার স্বস্তি দিতেই ২০১২ সালে কার্যক্রম শুরু করে সমবায় বাজার কনসোর্টিয়াম লিমিটেড (সবাক)। এটি সমবায় অধিদপ্তরের একটি উদ্যোগ ছিল। কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েছে এ ধারণা। উদ্দেশ্য ছিল প্রান্তিক পর্যায়ের সমবায়ীদের কাছ থেকে উৎপাদিত পণ্য সারা দেশে বিক্রির মাধ্যমে ক্রেতা-উৎপাদককে লাভবান করা। কিন্তু ৯ বছরে এ উদ্যোগ সফল হয়নি। সমবায় অধিদপ্তরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ হওয়ায় এ কার্যক্রম চোখে পড়ে না। সমবায় বাজার কনসোর্টিয়াম ঠাকুরগাঁওর সদস্য বেলাল উদ্দিন জানান, মূল উদ্দেশ্য সফল হয়নি। সিন্ডিকেট ভাঙতে বাজার ব্যবস্থায় সমবায় ধারণার সুফল মেলেনি। তিনি বলেন, সমবায়ীদের দোকানগুলো মুদি দোকানে রূপান্তর হয়েছে। মূলধন সংকট, নিজস্ব জায়গার অভাব, পণ্য উৎপাদন পর্যায়ে নীতি সহায়তা না থাকায় এ ব্যবস্থায় উপকার মিলছে না।
দুর্বল তদারকি ব্যবস্থা : বিকল্প বাজার ব্যবস্থার ধারণা সংকুচিত করে বাজার মনিটরিং করার দিকে জোর দেয় সরকার। এক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মনিটরিং সেল, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশনসহ বাজারে শৃংখলা আনতে কাজ করছে একাধিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের তদারকির পরও অযৌক্তিকভাবে বাড়ছে নিত্যপণ্যমূল্য। পণ্য বিক্রি পর্যায়ে রসিদ বাধ্যতামূলক, পরিবেশক আইন পরিপালন, প্রতিটি বাজারে মূল্য তালিকা প্রদর্শনের নিয়ম থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। এক্ষেত্রে তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর উদাসীনতা স্পষ্ট। ব্যবসায়ীদের চাপে পরিবেশক আইন এখন কার্যকর হয় না। ওই আইনে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির আগে ট্যারিফ কমিশনে সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে উৎপাদকদের আবেদন করার নিয়ম ছিল। তদন্ত করে মূল্য বৃদ্ধির যৌক্তিক কারণ থাকলেই শুধু দাম বাড়ানোর অনুমতি দিত রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এখন ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে রসিদ ব্যবহার বাধ্যতামূলক হলেও বেচাকেনা হয় ডিও (চাহিদাপত্র)। আর সিটি করপোরেশন থেকে নামকাওয়াস্তে ঢাকার কয়েকটি বাজারে মূল্য তালিকা টানিয়ে দেওয়া হলেও তা যাচাই করে না কেউ।
সক্রিয় সিন্ডিকেট : ‘সরকার ব্যবসা করবে না’ এমন ধারণা থেকেই ধীরে ধীরে সংকুচিত হয় বিকল্প বাজার ব্যবস্থা। যার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে সিন্ডিকেট। সরকারি প্রতিষ্ঠান নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার ফলে বাজারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে। হু হু করে বাড়ছে পণ্যমূল্য। মাত্র ৫ থেকে ৬ জন আমদানিকারকের হাতে পুরো পণ্য বাজারের নিয়ন্ত্রণ। এছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীদের অতিমুনাফার লোভে বাড়ছে দাম। শহরে পণ্যের দাম নিয়ে নানান সমীকরণ হলেও উৎপাদন পর্যায়ে ন্যায্যমূল্য পায় না কৃষক। পণ্য বাজারজাতকরণে নেওয়া হয়নি শক্তিশালী কোনো কৌশল। উৎপাদন পর্যায়েই মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট কম দামে পণ্য কিনে নেয়। পরে ওই সিন্ডিকেট কয়েকগুণ বেশি দামে পণ্য বিক্রি করে দেয়। পরে যতো হাতবদল হয়, বাড়ে দাম।
এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক বলেন, বর্তমান বাজার ব্যবস্থা ভোক্তাবান্ধব নয়, ব্যবসায়ীবান্ধব। মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারা চালুর পর রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে বাজার পরিচালিত হচ্ছে। সে চাহিদা ও যোগানের কাঠামোগত ধারণা বা আইনগত কোনো কৌশল তৈরি হয়নি। ফলে বিশেষ কোনো সময়, ধর্মীয় কোনো অনুষ্ঠান বা উৎসব পার্বণে পণ্যের চাহিদা বাড়ে এবং অসাধু ববসায়ীরা পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, উৎসবের সময় একবারে বাজারে পণ্যের চাপ কমাতে হবে। বাজারে পণ্য মজুদ, বিক্রি, সরবরাহ ব্যবস্থা কীভাবে চলছে তার একটা আইনগত ভিত্তি দাঁড় করাতে হবে।