আল্লাহ তায়ালা আসমান-জমিন সৃষ্টির সূচনা থেকেই বছরের বারোটি চান্দ্র মাস নির্ধারণ করেছেন। এ মাসগুলোর মধ্যে ‘শাহরু রামাদান’ বা ‘রমজান মাস’ আল্লাহ তায়ালার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানিত একটি মাস। এ মাসকে ‘শাহরুম মুবারাকাহ’ বা ‘বরকতময় মাস’সহ বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়। আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে মানব জাতিকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য তাঁর মনোনীত ব্যক্তিদের কাছে এ মাসেই ‘ওহি’ পাঠিয়েছিলেন এবং কোরআনও এ মাসেই অবতীর্ণ হয়। মহাগ্রন্থ কোরআন নাজিল হওয়ার কারণেই এ মাসের সম্মান-মর্যাদা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে এরশাদ হচ্ছে, ‘মাহে রমজান হলো সেই মাস, যাতে কোরআন অবতীর্ণ হয়। এটা মানুষের জন্য পথনির্দেশনার প্রমাণপঞ্জি ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)। আল কোরআনের মতো ‘শাহরু রামাদানে’ তাওরাত, ইঞ্জিল, যাবুরসহ সব আসমানি গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সহিফায়ে ইবরাহিম রমজানের প্রথম রাতে, তাওরাত রমজানের ছয় তারিখে, ইঞ্জিল রমজানের তের তারিখে ও আল কোরআন চব্বিশ তারিখে অবতীর্ণ হয়।’ (মুসনাদে আহমাদ)। কোরআন অন্যান্য আসমানি গ্রন্থের মতো মুহাম্মদ (সা.) এর ওপর একসঙ্গে অবতীর্ণ হয়নি, বরং এটা লাওহে মাহফুজ থেকে কদরের রাতে পৃথিবীর আসমান ‘বায়তুল ইজ্জাত’ নামক স্থানে একত্রে অবতীর্ণ হয় এবং নবী (সা.) এর কাছে ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ‘রমজানে’ শুরু হয়ে পরবর্তী ২৩ বছরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা এটি অবতারণ করেছি (কদরের) মহিমান্বিত রজনিতে।’ (আল কদর : ১)। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আব্বাস (রা.) এর কাছে হজরত আতিয়্যা ইবন আসওয়াদ জিজ্ঞেস করেন, আমার অন্তরে এই সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা এখানে বলেন, রমজান মাসে কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। অথচ আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেন, আমি কোরআনকে কদরের রাতে নাজিল করেছি। আবার এক আয়াতে বলেন, নিশ্চয় আমি একে এক পবিত্র রাতে নাজিল করেছি। অথচ শাওয়াল, জিলহজ, মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল ইত্যাকার বিভিন্ন মাসে অবতীর্ণ করেন। উত্তরে হজরত ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, কোরআন রমজান মাসে কদরের রাতে সম্পূর্ণটাই একবারে নাজিল হয়। অতঃপর এটা প্রত্যেক মাসে ও দিনে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছে। (মুসলিম)।
‘শাহরু রামাদান’ কোরআন নাজিলের মাস। এ মাসেই হেরা গুহায় মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি সর্বপ্রথম ওহিতে সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত অবতীর্ণ হয়। এসব আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম কোরআন পড়ার নির্দেশনা দেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে এক রক্তপি- থেকে। পড় তোমার প্রভু সম্মানিত। যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলমের সাহায্যে। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতই না।’ (সূরা কলাম : ১-৫)। কোরআনুল হাকিমে আল্লাহ তায়ালা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রনীতি, শিক্ষানীতি, সংস্কৃতিসহ সব নীতি সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে আখেরাতেও নাজাতের ব্যবস্থা করেছেন। রোজাদার কোরআন অধ্যয়নের মাধ্যমে কেয়ামতের দিন সুপারিশপ্রাপ্ত হবে। হাদিসে এসেছে, ‘সিয়াম ও কোরআন বান্দার জন্য কেয়ামতের দিন সুপারিশকারী হবে, সিয়াম বলবে, হে প্রভু আমি তাকে দিনের বেলায় খাওয়া এবং প্রবৃত্তির তাড়না থেকে নিবৃত্ত রেখেছি, তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন, আল্লাহ তায়ালা কলবেন, তাদের সুপারিশ গ্রহণ কর হলো।’ ‘কোরআন’ নাজিলের মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা এতটাই যে, এ সময় রাসুল (সা.) এর কোরআন তেলাওয়াত শোনার জন্য হজরত জিবরাইল (আ.) পৃথিবীতে আগমন করতেন এবং আল কোরআনের যতটুকু নাজিল হতো তা তিনি সম্মানিত ফেরেশতাকে শোনাতেন। এ প্রসঙ্গে ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘তিনি বলেন, নবী (সা.) ধন-সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে সবার চেয়ে দানশীল ছিলেন। রমজানে জিবরাইল (আ.) যখন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি আরও অধিক দান করতেন। রমজান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবারাইল তাঁর সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করতেন। আর নবী (সা.) তাকে কোরআন শোনাতেন। জিবারাইল (আ.) যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি রহমতসহ প্রেরিত বায়ুর চেয়ে অধিক ধন-সম্পদ দান করতেন।’ (বোখারি : ১৯০২)।
কোরআন ও হাদিসে রমজান মাসের বিভিন্ন গুরুত্বের কথা বর্ণিত হয়েছে। এ মাসে ইসলামের প্রথম যুদ্ধ ‘বদর’সহ বিভিন্ন যুদ্ধে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের বিজয় দান করেন। এ মাসেই রাসুলুল্লাহ (সা.) বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন। হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ রজনি ‘লাইলাতুল কদর’ রয়েছে এ মাসেরই শেষ দশকের কোনো এক রজনিতে। এ রজনীতেই মানবজাতির পথপ্রদর্শক কোরআনুল কারিম অবতীর্ণ হয়। এ পথনির্দেশক মহাগ্রন্থ মানবতার জন্য দিকনির্দেশক ও আলোকবর্তিকা। মহান আল্লাহ তায়ালা এর নাম দিয়েছেন ফোরকান (পার্থক্যকারী) যা হালাল-হারাম, হেদায়েত-গোমরাহি এবং হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে। এতে রয়েছে পূর্ববর্তীদের ঘটনাবলি, পরবর্তীদের সংবাদ, মোমেনদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ এবং কাফেরদের জন্য জাহান্নামের দুঃসংবাদের বর্ণনায় পরিপূর্ণ। এ প্রজ্ঞাময় গ্রন্থ মানুষকে হালাল, হারাম এবং শরিয়তের সীমারেখার প্রতি পথপ্রদর্শন করে। সত্য ও অসত্যকে পৃথক করে দেয়। বৈধ ও অবৈধকে সুস্পষ্ট করে তোলে। এ সর্বশেষ আসমানি গ্রন্থ বিশ^াসী সবার জন্য রহমত, গাফেল হৃদয়কে জাগ্রত ও সক্রিয় করে, অন্তরকে শিরক-নিফাক এবং শরীরকে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি থেকে সুস্থ করে তোলে। এ কোরআন অধ্যয়ন ও এর বিধি-বিধান পালনের মাধ্যমে আরবের বর্বর জাতি সুসভ্য ও সম্মানিত জাতিতে পরণিত হয়েছিল। রমজানে আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি সৎকাজের পুরস্কার সত্তরগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। আসুন, ‘কোরআন নাজিলের’ মাসে কোরআন অধ্যয়ন করে নিজেদের মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি করে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ লাভ করি।
লেখক : সিনিয়র লেকচারার, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, উত্তরা ইউনিভার্সিটি