আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১০-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

মক্কা শরিফের জুমার খুতবা

রমজানের বহুমুখী কল্যাণ ও মর্যাদা

শায়খ ড. মাহের বিন হামদ মুআইকিলি
| ইসলাম ও সমাজ

আপনাদের দুয়ারে উপনীত এমন কতগুলো পবিত্র রাত ও মর্যাদাপূর্ণ দিন, যার আগমনে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) সুসংবাদ শোনাতেন। মুসনাদে আহমাদে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবিদের সুসংবাদ শুনিয়ে বলতেন, ‘তোমাদের মাঝে আগমন করেছে রমজান। এমন এক পবিত্র মাস আল্লাহ যাতে তোমাদের ওপর ফরজ করেছেন সিয়াম সাধনা। এতে খুলে দেওয়া হয় জান্নাতের দরজাগুলো। বন্ধ করা হয় জাহান্নামের দুয়ারগুলো। বন্দি করা হয় শয়তানদের। এতে রয়েছে এমন এক রাত, হাজার মাস থেকে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে সমূহ কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।’ 
ইবনে রজব (রহ.) বলেন, ‘রমজান মাসের আগমনে একে অপরকে শুভেচ্ছা জানানোর ক্ষেত্রে এ হাদিসটিই মূল। মোমিন কীভাবে পারবে জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়ার সুসংবাদ না নিয়ে? অপরাধী কীভাবে পারবে জাহান্নামের দরজা বন্ধ হওয়ার সুসংবাদ না নিয়ে? জ্ঞানীমাত্রেই সুসংবাদ না নিয়ে পারবে কীভাবে ওই সময়ের যখন শয়তানকে বন্দি করা হয়। এ সময়ের সঙ্গে তুল্য আর কোনো সময় আছে?’ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বল, আল্লাহর দয়া ও মেহেরবানিতে। সুতরাং এরই প্রতি তাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। এটিই উত্তম সে সমুদয় থেকে যা সঞ্চয় করছ।’ (সূরা ইউনুস : ৫৮)। 
‘রমজান হলো সিয়াম ও কিয়ামের মাস। রোজা ও তারাবির মাস। কোরআন ও এহসানের মাস। এ মাসে একত্রিত হয়েছে সেরা দুই আমল। কেননা সিয়াম ও কোরআন বান্দার জন্য কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা মেটানো থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং আমার সুপারিশ কবুল করুন। তখন দুজনের সুপারিশই গ্রহণ করা হবে।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
নবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি  ঈমান ও সওয়াবের আশায় সিয়াম পালন করবে, তার পূর্ববর্তী পাপরাশি ক্ষমা করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি রমজানে ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের আশায় রাত জেগে সালাত আদায় করবে, তার আগের যাবতীয় গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় কদরের রাতে দ-ায়মান থাকবে, তার আগের গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ 
রোজাদারের প্রতিদানের দায়িত্ব নিয়েছেন খোদ আল্লাহ তায়ালা। বোখারির হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘প্রত্যেক আদম সন্তানকে তার নেক আমল দশগুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেওয়া হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তবে সিয়ামের প্রতিদান ছাড়া; কারণ সিয়াম আমার জন্য আর আমিই তার প্রতিদান দেব। কেননা আমার কারণে সিয়াম পালনকারী তার যৌনকার্য ও আহার বর্জন করে থাকে।’ 
এটি মহান মাস। সম্মানিত মৌসুম। এ মাসে ফেরেশতারা রোজাদারের জন্য ইফতার পর্যন্ত এস্তেগফার করতে থাকেন। এতে রোজাদারের জন্য রয়েছে দুটি আনন্দের কারণÑ যখন ইফতার করে, ইফতার গ্রহণের মাধ্যমে আনন্দ পায়। আর যখন আপন প্রভুর সঙ্গে মিলিত হবে, রোজার সুবাদে তখন আনন্দিত হবে। 
এ মাসে আল্লাহ তায়ালা জান্নাতকে প্রতিদিন সুসজ্জিত করেন। অতঃপর তিনি জান্নাতের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘অচিরেই আমার নেককার বান্দাদের থেকে কষ্ট ও বোঝা দূর করে দেওয়া হবে এবং তোমার কাছে চলে আসবে।’ আল্লাহর ঘোষক এ মাসে প্রতি রাতে ঘোষণা করতে থাকেন, ‘হে কল্যাণপ্রত্যাশী অগ্রসর হও। হে অকল্যাণকামী নিবৃত হও।’ 
অন্তর এ মাসে তার রবের নৈকট্য লাভ করে। হৃদয় এ মাসে তার স্রষ্টার জন্য নিবিড় হয়। এতেই রয়েছে আলোকিত শেষ দশ দিন। আছে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম লাইলাতুল কদর। 
রমজানের ফজিলতের আরেকটি দিক হলো, যে ব্যক্তি ইমামের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সালাত (তারাবি) আদায় করবে, তার আমলনামায় সারারাত সালাত আদায়ের সওয়াব লেখা হবে। এতে আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক রাতে অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। নাক ধূলি ধুসরিত, নাক ধূলি ধুসরিত, নাক ধূলি ধুসরিত ওই ব্যক্তির যে রমজান পেল অথচ তাকে ক্ষমা করা হলো না। 
রোজাদারের জন্য রমজানে রয়েছে কিছু অব্যর্থ দোয়া। রমজানে দোয়া কবুলের সময় অনেক। অতএব এতে বেশি বেশি দোয়া করুন। কেননা মহান আল্লাহ রোজার আয়াতগুলোর মধ্যে তার মোমিন বান্দাদের কাছে টেনে নেওয়া এবং প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুলের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে বস্তুত আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নিই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য। যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে।’ (সূরা বাকারা : ১৮৬)। তেমনি মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। ১. রোজাদারের দোয়া ইফতার করা পর্যন্ত, ২. ন্যায়পরায়ণ বাদশাহর দোয়া, ৩. মজলুমের দোয়া।’
রমজানে কল্যাণের দ্বার অনেক। যে ব্যক্তি রোজাদারকে একটি খেজুর দিয়েও ইফতার করাবে তারও রোজাদারের মতো সওয়াব হবে; অথচ রোজাদারের সাওয়াব বা নেকি বিন্দুমাত্র কমানো হবে না। তেমনি রমজানের দান-সদকা শ্রেষ্ঠ দান। অতএব যে হিসাব দিনের ভয় করে, সে যেন দুস্থ ক্ষুধার্তকে খাওয়ায়। বিধবা ও এতিমের অভাব দূর করে। ‘তারা আল্লাহর জন্য অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দিকে আহার্য দান করে। তারা বলে, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদের আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না। আমরা আমাদের পালনকর্তার তরফ থেকে এক ভীতিপ্রদ ভয়ংকর দিনের ভয় রাখি। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে সেদিনের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন এবং তাদেরকে দেবেন সজীবতা ও আনন্দ। এবং তাদের সবরের প্রতিদানে তাদেরকে দেবেন জান্নাত ও রেশমি পোশাক।’ (সূরা ইনসান : ৮-১২)।
রমজান মাস তাকওয়ার সেরা মৌসুম। রোজা হলো ঢাল। অর্থাৎ অশ্লীলতা ও হারাম থেকে বাঁচার সুরক্ষা দুর্গ। আল্লাহ জাল্লা শানুুহু রোজার আয়াত শুরু করেছেন তাকওয়ার প্রসঙ্গ দিয়ে, শেষও করেছেন একই প্রসঙ্গের মাধ্যমে। কেননা তাকওয়া শ্রেষ্ঠতম পাথেয়। তাকওয়ার পোশাক সর্বোত্তম পোশাক। ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য নিষ্কৃতির পথ করে দেন। এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেন।’ (সূরা তালাক : ২-৩)। ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার পাপ মোচন করেন এবং তাকে মহাপুরস্কার দেন।’ (সূরা তালাক : ৫)। ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন।’ (সূরা তালাক : ৪)। 
আল্লাহ তায়ালা তাকওয়ার অধিকারীদের বিশিষ্ট করেছেন তাঁর সঙ্গী বলার মাধ্যমে। তাদেরকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তাঁর ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। ‘যে লোক নিজ প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করবে এবং তাকওয়া অবলম্বন করবে, অবশ্যই আল্লাহ তাকওয়াবানদের ভালোবাসেন।’ (সূরা আলে ইমরান : ৭৬)।
কাতাদা (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে, আল্লাহ তার সঙ্গে থাকেন। আর আল্লাহ যার সঙ্গে থাকেন, তার সঙ্গে থাকে এমন একদল যাদের হারানো যায় না। এমন নিরাপত্তারক্ষী যিনি ঘুমান না। এমন পথপ্রদর্শক যিনি পথ হারান না।’
তাকওয়ার অধিকারীরাই উচ্চ মর্যাদা পাবেন আখেরাতে ও দুনিয়ায়। ‘এই পরকাল আমি তাদের জন্য নির্ধারিত করি, যারা দুনিয়ার বুকে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে ও অনর্থ সৃষ্টি করতে চায় না। তাকওয়াবানদের জন্য শুভ পরিণাম।’ (সূরা কাসাস : ৮৩)। 
তাকওয়ার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয় জান্নাতের চিরস্থায়ী সৌভাগ্য, যার প্রশস্ততা দুনিয়া-আসমানের মতো, যা প্রস্তুত করা হয়েছে তাকওয়াবানদের জন্য। যেখানে আছে এমনসব নেয়ামতÑ যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি এবং কোনো মানবহৃদয় কল্পনা করেনি। ‘মনে রেখো যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের না কোনো ভয়-ভীতি আছে, না তারা চিন্তান্বিত হবে। যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে। তাদের জন্য সুসংবাদÑ পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে। আল্লাহর কথার কখনও হেরফের হয় না। এটাই হলো মহাসফলতা।’ (সূরা ইউনুস : ৬২-৬৪)। 
মাহে রমজান হলো প্রভু রহমানকে খুশি করার সুযোগ। তাঁর পথে অবিচল এবং তাঁর সঙ্গে মিলিত হওয়ার প্রস্তুতির সুযোগ। আজ শুধু আমল, হিসাব নেই। আগামীকাল শুধু হিসাব, আমল নেই। অতএব সেদিনের পাথেয় সংগ্রহ করুন। আর উত্তম পাথেয় হলো তাকওয়া। ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’ (সূরা বাকারা : ১৮৩)।


২৮ শাবান ১৪৪০ হিজরি মক্কার মসজিদে হারামের খুতবা মক্কা থেকে 
অনুবাদ করে পাঠিয়েছেন আলী হাসান তৈয়ব