মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি করছে কর্তৃপক্ষ। বিমানের জনসংযোগ শাখার জিএম শাকিল মেরাজ জানান, তাদের চিফ অব ফ্লাইট সেইফটি ক্যাপ্টেন শোয়েব চৌধুরী ৬ সদস্যের এ তদন্ত দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বুধবার সন্ধ্যায় ইয়াঙ্গুন বিমানবন্দরে অবতরণের সময় রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়া ড্যাশ ৮-কিউ ৪০০ উড়োজাহাজটির ক্ষতি নিরূপণে বিমানের গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারদের একটি দল মিয়ানমার গেছে বলেও জানান শাকিল মেরাজ।
ঢাকা থেকে ২৯ জন যাত্রী, চারজন ক্রু ও দুজন গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারসহ মোট ৩৫ জন আরোহী নিয়ে বুধবার বিকালে মিয়ানমারের পথে রওনা হয়েছিল বিমানের ফ্লাইট বিজি ০৬০। কিন্তু ইয়াঙ্গুনে নামার সময় উড়োজাহাজটি বজ্রঝড়ের কবলে পড়ে। সন্ধ্যা ৬টা ২২ মিনিটে অবতরণের পর বিমানটি ছিটকে রানওয়ের বাইরে চলে যায়। দুর্ঘটনার পর দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ইয়াঙ্গুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ ওঠানামা বন্ধ থাকে। ওই দুর্ঘটনা এবং যাত্রীদের সর্বশেষ
অবস্থা জানাতে বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন শাকিল মেরাজ। তিনি বলেন, ইয়াঙ্গুন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ওই বিমানের আরোহীদের মধ্যে মোট ১৮ জনকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করেছিল। তাদের মধ্যে চারজনকে বুধবার রাতেই প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। বাকিদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা সেখানে আছেন। তারা সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিচ্ছেন, তদারকি করছেন। যে ১৪ জন সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের সর্বোচ্চ ভালো চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যা যা করা দরকার, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে তার সবকিছুই করা হচ্ছে। তবে হাসপাতালে ভর্তি থাকা যাত্রীদের কার কী অবস্থা সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য দেননি বিমানের জনসংযোগ শাখার জিএম। তিনি বলেন, বিমানের কান্ট্রি ম্যানেজার মীর আক্তার সেখানে আছেন, বুধবার সন্ধ্যা থেকে সার্বক্ষণিক আপডেট নিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাক আছে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী যাত্রীদের জন্য যে ধরনের সাপোর্ট লাগবে আমরা সেটি বিমানের পক্ষ থেকে দেব।
দুর্ঘটনার পর সামাজিক মাধ্যমে আসা ছবিতে ওই বিমানের পাইলট শামীম নজরুলকে রক্তাক্ত অবস্থায় হেঁটে বিমান থেকে টার্মিনালে আসতে দেখা যায়। তাকেও হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান শাকিল মেরাজ। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হলো, এ দুর্ঘটনায়, আমাদের যাত্রী এবং ক্রু সবাই নিরাপদে আছেন, বড় কোনো সমস্যা হয়নি। তাদের চিকিৎসা চলছে, আশা করছি, তারা দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন।
যাত্রীদের মধ্যে কতজন বিদেশি নাগরিক ছিলেন, সে তথ্য শাকিল মেরাজ সংবাদ সম্মেলনে দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ২৯ জনের মধ্যে একজনের বয়স ছিল ২ বছরের কম। তাদের কতজন দেশি, কতজন বিদেশি বা ক’জন কোন দেশের নাগরিক তা পাসপোর্ট চেক করে আমরা আপনাদের জানাব।
মিয়ানমার থেকে বুধবার যে যাত্রীদের নিয়ে বিমানের ওই ফ্লাইটের ফেরার কথা ছিল, তারা ইয়াঙ্গুন বিমানবন্দরে আটকা পড়েছিলেন। তাদের নিয়ে আসার জন্য বিমানের বিশেষ ফ্লাইট বিজি ১০৬০ রাতে ঢাকা থেকে মিয়ানমার পাঠানো হয়। বৃহস্পতিবার ভোর পৌনে ৫টায় ১৭ জন অপেক্ষমাণ যাত্রী নিয়ে ফ্লাইটটি ঢাকায় ফিরেছে বলে জানান শাকিল মেরাজ। উড়োজাহাজটির কতটা ক্ষতি হয়েছে তা শাকিল মেরাজের কাছে জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা। উত্তরে তিনি বলেন, আমরা যেটুকু ছবিতে দেখেছি, একটি হিউজ ইমপ্যাক্ট তৈরি হয়েছে অ্যাক্সিডেন্টের পর, বডির স্ট্রাকচারাল ড্যামেজ হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য বিমানের পক্ষ থেকে গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারদের একটি টিম সেখানে গেছে। তারা সেখান থেকে এসে অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট দিলে আমরা মিডিয়া আপডেট দেব। বিমানটি কতদিন আগে আনা হয়েছিল, কতদিনের পুরনোÑ এ বিষয়ে প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি শাকিল মেরাজ।
মিয়ানমারের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসা ছবিতে কানাডার কোম্পানি বম্বার্ডিয়ারের তৈরি ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজটিকে ভাঙা ডানা নিয়ে রানওয়ের পাশে ঘাসের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
এভিয়েশন সেইফটি নেটওয়ার্ক জানায়, ওই বিমানে আগুন না ধরলেও ফিউজিলাজ ভেঙে তিন টুকরো হয়েছে। ফরোয়ার্ড প্যাসেঞ্জার ডোরের পেছনে এবং রিয়ার সার্ভিস ডোরের ঠিক পেছনে কাঠামো ভেঙে গেছে। উড়োজাহাজের তলাও ফেটে গেছে। ডান পাশের ডানাও জোড়া থেকে ভেঙে গেছে। বিমান কর্মকর্তা শাকিল মেরাজ বলেন, আহত যাত্রীদের স্বজনরা যাতে জরুরি প্রয়োজনে যোগযোগ করতে পারেন, সেজন্য বিমানের অপারেশন্স কল সেন্টারে একটা হট লাইন চালু করা হয়েছে। এর নম্বর +৮৮০২৮৯০১৫৩০। তাছাড়া সর্বশেষ তথ্যগুলো আগামী দুদিন সাংবাদিকদের ডেকে ব্রিফ করা হবে।
আহত যাত্রীদের চিকিৎসা খরচ ও ক্ষতিপূরণ দেবে বিমান বাংলাদেশ : মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন বিমানবন্দরে অবতরণের সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে যেসব যাত্রী আহত হয়েছেন, তাদের চিকিৎসা খরচ ও ক্ষতিপূরণ দেবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক শাকিল মেরাজ এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, বিমানটি বীমার আওতায় রয়েছে। বীমার শর্ত অনুসারে আহত যাত্রীরা ক্ষতিপূরণ পাবেন। তবে কে কতটা আহত হয়েছেন এসব পর্যবেক্ষণ করে বীমা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। তিনি বলেন, যাত্রীদের সব ধরনের সেবা ও সহযোগিতা দেওয়ার জন্য বিমানের পক্ষ থেকে উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের বাংলাদেশ দূতাবাসও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যাত্রীদের সার্বিক বিষয়ে তদারকি করছে, তাদের খোঁজখবর রাখছে। ১৪ জন মিয়ানমারে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানান শাকিল মেরাজ। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেই ফ্লাইটে বাংলাদেশের ১৫ জন, চীনের পাঁচজন, মিয়ানমারের তিনজন, ডেনমার্কের একজন, ফ্রান্সের একজন, ব্রিটেনের দুজন, কানাডার একজন ও ভারতের একজন যাত্রী ছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন চীনের দুজন, মিয়ানমারের দুজন, ভারতের একজন, কানাডার একজন ও বাংলাদেশের ১২ জন।
প্রসঙ্গত, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ইয়াঙ্গুনগামী ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজের ফ্লাইটটি (বিজি-০৬০) ঢাকা থেকে বুধবার বিকাল ৩টা ৪৫ মিনিটে ত্যাগ করে। বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টার দিকে ইয়াঙ্গুনে অবতরণের সময় বৈরি আবহাওয়ার কবলে পড়ে সেটি রানওয়ে থেকে ছিটকে যায়। এ ঘটনায় ১৯ যাত্রী আহত হন।