আসছে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট। বাজেট নিয়ে বরাবরের মতো এবারও প্রত্যাশায় বিনিয়োগকারীরা। তবে বাজেট সামনে রেখে এরই মধ্যে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে অর্থমন্ত্রী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক পুঁজিবাজারের জন্য সুসংবাদ দিয়েছেন। নিয়েছেন পুঁজিবাজারবান্ধব উদ্যোগ। কিন্তু তাতেও যেন আস্থা ফিরছে না পুঁজিবাজারে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা এখন শূন্যের কোঠায়। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর জন্য বাজারে লেনদেন বাড়ানো থেকে শুরু করে সূচকের ঊর্ধ্বমুখী অবস্থা দৃশ্যমান করা জরুরি। একই সঙ্গে বাজারের মৌল ভিত্তিক বা ভালো মানের শেয়ারের দর পতনও বিনিয়োগাকরীদের নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। বাজার বিনিয়োগকারীরা বলছেন, এ সময়ে যে শেয়ারের দাম বাড়ছে না তা কিন্তু নয়। তবে দিনের যে ১০টি শেয়ারের সবচেয়ে বেশি দাম বাড়ছে তার মধ্যে সাতটিই থাকছে জেড ক্যাটাগরি বা খারাপ কোম্পানির। এর ফলে আস্থাহীনতা আরও বাড়ছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট কাটানোসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবীরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন। জানা গেছে, বৈঠকের প্রধান আলোচ্য বিষয় হচ্ছে বাজারে গতিশীলতা ফেরানো। এটি করার জন্য বাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়াতে হবে, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রক্ষণশীল অবস্থান আর কিছু বিধিনিষেধের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, বিশেষ করে ব্যাংকের বিনিয়োগের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আছে। স্টেকহোল্ডারদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশ ব্যাংককে বিষয়গুলো বিবেচনা করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক মো. রকিবুর রহমান বলেছেন, পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় করা এবং সে সঙ্গে তারল্য সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিবাচক ভূমিকা খুবই জরুরি।
পুঁজিবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য আগামী বাজেটে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। প্রাক-বাজেট আলোচনায় তিনি বলেছেন, পুঁজিবাজারের উন্নয়নের বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী উদ্বিগ্ন। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা সে বিষয়ে কাজ করছি। শেয়ারবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য আগামী বাজেটে যে কর প্রণোদনা আছে সেটা অব্যাহত থাকবে। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের বিশেষ সুবিধা হিসেবে আগেরবারের মতো ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। অর্থমন্ত্রীও এ ব্যাপারে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা সে বিষয়ে কাজ করছি।
এরই মধ্যে পুঁজিবাজারে ক্ষত্রিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা পুনঃঅর্থায়নের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। নতুন তহবিল নয়, এর আগে প্রণোদনা স্কিমের আওতায় আইসিবির মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণের আসল ও সুদ পুনরায় ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে। আর আগের মতোই এই তহবিল সরাসরি নিজে ব্যবহার না করে, ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী, মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারহাউসকে ঋণ হিসেবে দেবে, তারল্য সুবিধা বাড়ানোর জন্য। তারা ওই অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করবে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত একটি চিঠি ইস্যু করেছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, চলমান পুঁজিবাজারের লেনদেনে নিম্নগতির ধারা প্রতিরোধের লক্ষ্যে সুদ ও আসল হিসেবে আদায়কৃত মোট ৮৫৬ কোটি টাকা আবর্তনশীল ভিত্তিতে পুনঃব্যবহার এবং তিনটি বিষয়ের নির্দেশক্রমে অর্থ বিভাগের সম্মতি দেয়া হলো। এর আগে ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে প্রণোদনা স্কিমের আওতায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আইসিবিকে একটি তহবিল দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ তহবিলের মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তহবিলটির মেয়াদ বাড়িয়েছে। ওই তহবিলের শেষ বিতরণকৃত ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ৩১ মার্চ পর্যন্ত।
সম্প্রতি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের এসএমই প্লাটফর্ম উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, আপনারা শেয়ার বিক্রি করবেন না। এখন শেয়ার বিক্রি করা হবে সবচেয়ে বড় বোকামি। কারণ বাংলাদেশে এ মুহূর্তে অর্থনীতির সব সূচক ভালো অবস্থায় আছে। এখন (পুঁজিবাজারে) যে পতন হচ্ছে, তা অত্যন্ত সাময়িক। যে সমস্যাগুলো আছে, আমরা সেগুলো সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছি। আগামী বাজেটে আমরা বেশ কিছু প্রণোদনা পুঁজিবাজারের জন্য দেব। তখন শেয়ারের দাম বাড়বে, তখন শেয়ার বিক্রি করে অনেক লাভ করতে পারবেন। এজন্য যা বিক্রি করেছেন করেছেন, (এখন) আর শেয়ার বিক্রি করবেন না।
এছাড়া সর্বশেষ সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আগামী বাজেটে ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের উপযোগী সব থাকবে। তবে বাজেটের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে বলার সময় এখনও আসেনি।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ জানান, সরকার প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য ফান্ড দিয়েছে। ফলে আশার সঞ্চার হয়েছে পুঁজিবাজারে। মন্দা বাজার থাকলে বিনিয়োগকারীদের ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা উচিত।
বাজার বিশ্লেষক দেবব্রুত কুমার সরকার আলোকিত বাংলাদেশকে জানান, পুঁজিবাজার নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত যেসব উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে সবই ইতিবাচক। কিন্তু সেগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি। আর বাজেট নিয়ে প্রতি বছরই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন প্রত্যাশা কাজ করে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখেছি বাজেটে যেসব প্রণোদনা দেওয়া হয় তাতে ব্রোকার হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বেশি উপকৃত হয়ে থাকে। বাজেটের মাধ্যমে যেন ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী নয় সব শ্রেণির বিনিয়োগকারী উপকৃত হয় সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত।
এমন অবস্থায় পুঁজিবাজারের নতুন করে আইপিও না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি। কমিশনের ৬৮৪তম সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস্যু) রুলস, ২০১৫ এর সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এই সংশোধন হওয়ার আগ পর্যন্ত ৩০ এপ্রিল থেকে আইপিও সংক্রান্ত নতুন কোনো আবেদন নেওয়া হবে না। তবে এরই মধ্যে যেসব কোম্পানির আইপিও আবেদন জমা পড়ে আছে সেগুলোর ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বিবেচনা করা হবে। অর্থাৎ আইপিওর জন্য আবেদন দাখিল করা কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে আগের নিয়মেই অনুমোদন দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের সভাপতি আ ন ম আতাউল্লাহ নাঈম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরেই আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে বাজারের যে চিত্র তাতে আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই। অর্থমন্ত্রী বাজেটে যে বরাদ্দ দেবেন বা সুযোগ-সুবিধা দেবেন তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কতটা উপকৃত হবে, পুঁজিবাজার কতটা ভালো হবে তা সে সময়ে বিষয়। কিন্তু বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে বাজেট আসতে আসতে সিংহভাগ বিনিয়োগকারীই বাজার থেকে হারিয়ে যাবে। তিনি বলেন, এ সময়ে সিংহভাগ খারাপ কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে। ভালো কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দর এখন তলানিতে। এ বিষয়টিও খাতিয়ে দেখা উচিত।