দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার হিসেবে চাকরি করছি। হাজার হাজার রোগীকে বহন করেছি, তবে নুসরাতের মতো এরকম আগুনে পোড়া কোনো রোগী বহন করিনি। গাড়ির মধ্যে তার আর্তচিৎকার আজও আমার কানে বাজে। এ চিৎকারের দৃশ্য মনে পড়লে আমার ঘুম ভেঙে যায়। কথাগুলো বলছিলেন সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক নূর করিম।
নুসরাতের জীবন বাঁচাতে দ্রুত গতিতে অ্যাম্বুলেন্স চালিয়ে সেদিন ফেনী সদর হাসপাতালে গিয়েছিলেন নূর করিম। তিনি বলেন, আমার মনে হয়, ‘আমি এত দ্রুত গতিতে অ্যাম্বুলেন্স চালিয়েছি আমার চাকরি জীবনে এরকম ঘটনা ঘটেনি।’ ছোট চাকরি করেন বলে গণমাধ্যমে কোনো বক্তব্য দিয়ে বিপদে পড়তে চান না করিম। আবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল। নিজ কর্মের প্রতি আস্থার কারণে চাকরিবিধি মেনে গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হন তিনি। তারপরও এ প্রতিবেদককে বলেন, ভাই এটি স্পর্শকাতর বিষয়, ক্ষতি হলে কিছু লেইখেন না। সেদিন ছিল ৬ এপ্রিল আনুমানিক সকাল সাড়ে ১০টা। সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে কর্মরত মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট মো. ইসমাইল আমাকে মোবাইলে কল দিয়ে বলেন করিম আপনি কোথায়? এক মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে জরুরি বিভাগের সামনে আসেন। আমি তখন হাসপাতালের ভেতরে অ্যাম্বুলেন্সটি পার্কিং করছিলাম। পার্কিং না করে এক মিনিটের মধ্যে জরুরি বিভাগের সামনে হাজির হই। দেখি আগুনে পোড়া মাদ্রাসার এক ছাত্রী নুসরাতকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছেন কর্তব্যরত ডা. আরমান ও তার সহকারীরা। তার কান্না আর হাসপাতালে উপস্থিত তার ভাইয়ের অসহায়ত্ব দেখে আমি নিজেই বিচলিত হয়ে যাই। এদিকে ওই ছাত্রীকে উদ্ধারকারী কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য রাসেল ও মাদ্রাসার নাইট গার্ড মো. মোস্তফা তাকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়েছেন। তাদেরও চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। নুসরাতকে সবাই তাড়াহুড়ো করে ধরাধরি করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিলেন। আহত কনস্টেবল সামনের সিটে বসলেন। অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে মেয়েটির সঙ্গে তার ভাই উঠল। পুলিশের কনস্টেবল বলেন গাড়ি ঘুরিয়ে তাকে থানায় নিয়ে ওসি সাহেবকে দেখাতে। তার কথামতো অ্যাম্বুলেন্স থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওই সময় ওসি তদন্ত মো. কামাল হোসেন এবং দারোগারা থানায় ছিলেন। মেয়েটির চিৎকার শুনে সবাই এগিয়ে এক নজর দেখে কেউ স্থির থাকতে পারেননি। সবার চোখে জল। বললেন এক মিনিট দেরি না করে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। তাদের কথা মতো ফেনীর দিকে ছুটে যাই। এদিকে খবর পেয়ে এক নজর দেখার জন্য মেয়র সাহেব তার বাড়ির দরজায় অপেক্ষা করছেন। সোনাগাজী-ফেনী সড়কে তার বাড়ির সামনে তাকে এক নজর দেখিয়ে শুধু দোয়া চেয়ে অ্যাম্বুলেন্স টান মারি। ফেনীর দিকে যেতে যেতে তার ভাই তাকে প্রশ্ন করছে, কারা তোকে আগুন দিয়েছে? কেন দিয়েছে? তখন মেয়েটি বলতে থাকে ‘একজন মেয়ে তাকে পরীক্ষার হলে বলে নিশাদেরে ছাদের ওপর মারিহালার। এই খবর শুনে আঁই ছাদের উপর গেলে বোরকা পরা চোখে চশমা ও হাত মোজা পরা চারজন লোক আমারে বলে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছিস সেটা তুলতে হবে। একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিতে এগিয়ে দেয়। আমি বলি অধ্যক্ষ কেন ওস্তাদ হয়ে আমার সর্বনাশ করতে চেয়েছে? আমি কোনো প্রকারেই মামলা তুলবো না। তখন তারা আঁর মুখ চেপে ধরে হাত-পা বেঁধে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দে।’ ভাই আবার প্রশ্ন করে তুই হেগুনেরে চিনসনি, তখন মেয়েটি বলে কণ্ঠটি চেনা চেনা মনে হচ্ছে। রাখেন আমি মনে আনি। এই কথা বলেই একটি চিৎকার মারতে থাকে। আবার কিছুকক্ষণ চুপ থাকে। কেন যেন তার ভাইয়ের মনে জানা হয়ে গেছে বোন মনে হয় আর বাঁচবে না। তখন সে বোনকে বলতে থাকে, বোন তোমার অতীত ভুল-ত্রুটির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। তওবা পড়। আরবি একটি সুরা পড়িয়ে বোনকে সে তওবা করাতে থাকে। আমি অ্যাম্বুলেন্স চালালেও আমার মনটি শুধু মেয়েটির বাঁচার আকুতির দিকে পড়ে আছে। এরই মাঝে এসে গেলাম ফেনী সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে। সবাই ধরাধরি করে মেয়েটিকে নামিয়ে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করল। দেখতে পেলাম সেখানে সোনাগাজী মডেল থানার ওসি তদন্ত কামালও হাজির। চিকিৎসকরা মেয়েটিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে নিয়ে যেতে বলেন। পকেটে টাকা না থাকা অসহায় ভাইয়ের কান্না দেখলাম। কীভাবে নিয়ে যাবে তাকে ঢাকা মেডিকেলে। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়াও ছিল না তার পকেটে। ওসি তদন্ত কামাল একটি অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করেন। তার ভাই যখন কামালকে জানাল তার পকেটে টাকা নেই। তখন তিনি তাকে বললেন, টাকার ব্যাপারে তুমি চিন্ত কইরো না। আমি দেখছি। তাদের ঢাকার দিকে তড়িঘড়ি করে পাঠিয়ে আমাকে ২০০ টাকা বখশিশ দিয়ে বিদায় করেন। পরে আমি সোনাগাজী ফিরে আসি। সোনাগাজী এসে গণমাধ্যমের সুবাধে এবং ফেইসবুকের মাধ্যমে মেয়েটির সব খবর শুনতে পাই। পাঁচ দিন পরে তো মেয়েটি মারাই গেল। আল্লাহ তার বেহেশত নসিব করুক। পরে একদিন তদন্তে এসে পুলিশের ডিআইজি আমার বক্তব্য শুনেছেন। আমি সেই দিনের দৃশ্যগুলো উনাকে বলেছি। মুমূর্ষু রোগীদের জীবন বাঁচাতে সাইরেন বাজিয়ে মুহূূর্তের মাঝে হাজির হন করিম ড্রাইভার। অনেকটা নিজ বিবেকের তাড়নায় মানবিক লোকও বলা চলে তাকে। নিজের দায়িত্ববোধ থেকে অসুস্থ মানুষের জীবন বাঁচাতে ছুটে চলেন নিরন্তর। তিনি সব শেষ বলেন, নুসরাতের মতো এমন অবস্থা যেন আর কোনো মেয়ের জীবনে না ঘটে।