এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থীর বাবা-মা, অভিভাবক অনন্দে আত্মহারা হয়েছেন, অনেকে বা শোকে নিস্তব্ধ হয়ে আছেন। কারণ তাদের সন্তান জিপিএ-৫ পেয়েছে অথবা পায়নি। জিপিএ-৫ এখন এমন এক প্রত্যাশা হয়ে দাঁড়িছে যে, সবার এটা চাই। এটা যেন সামাজিকভাবে ছোট করছে পরিবারকে। তাই জিপিএ-৫ চাই-ই চাই। যে কোনোভাবেই হোক। তাই পরীক্ষার আগে বা ফল প্রকাশের পর আশানুরূপ ফলাফল না হলে যেন অনাকাক্সিক্ষত এক ক্ষতি হয়ে যায় পরিবারের। তাই ফলাফল খারাপের সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানেরও খারাপ সম্পর্ক তৈরি হয়।
এদিকে খারাপ ফলাফল হলে ভালো কলেজে ভর্তি হওয়া যায় না। এটা ভালো ফলাফলের আরেক দিক। তাই ভালো ফলাফল করতেই হবে। এ খারাপ ফলাফলের প্রভাব শহরের চেয়ে গ্রামে বা মফস্বলে বেশি। এখানে ফলাফল খারাপ হওয়ার নানাবিধ কারণ আছে। খারাপ ফলাফল হওয়ায় গ্রাম থেকে শহরের ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া সম্ভব হয় না। তাই কারণে অকারণে পিছিয়ে পড়ে গ্রামের শিক্ষার্থীরা। একটি কথা বলতে চাই, পার্থক্য শুধু গ্রাম-শহরের, মেধার নয়Ñ এটা মাথায় রাখতে হবে। তাদের ভালো সুযোগ-সুবিধা দিলে তারও জিপিএ-৫ পেত। নিঃসন্দেহে বলা যায় এটা। এ পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য এগিয়ে আসা দরকার সরকারের। গ্রাম-শহর সব জায়গা সমান সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা অতিব জরুরি আগামীর সুবর্ণ স্বর্ণালি বাংলাদেশের জন্য।
আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয়, ভালো ফলাফলে নতুন সংশয় ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তির জন্য চাহিদার চেয়েও প্রায় সাড়ে ১২ লাখ আসন বেশি আছে। তারপরও আতঙ্কে দুশিন্তায় আছেন সর্বোচ্চ ফলাফল জিপিএ-৫ প্রাপ্তরা। কারণ দেশের মানসম্মত প্রায় পৌনে ২০০ কলেজের ৫০ হাজারের মতো আসনের বিপরীতে এ বছর জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৫৯৪ জন। সেই হিসাবে জিপিএ-৫ পেয়েও প্রায় অর্ধলাখ শিক্ষার্থী প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাবে না। এদের অধিকাংশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। ফলে মানসম্মত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া নিয়ে রয়েছে উৎকণ্ঠা। শুরু হয় অসুস্থ প্রতিযোগিতা। কারণ সন্তান কোন কলেজে পড়ছে, এটা যেন পারিবারিক অহংকার গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমার ছেলে সনামধন্য এই প্রতিষ্ঠানে পড়ে, আমার মেয়ে এখানে পড়ে। কলেজ কি কারও ফলাফল ভালো করে দিতে পারে? যদি শিক্ষার্থীরা নিজে না পড়ে। হ্যাঁ তবে পরিবেশ মানুষকে অনেক পরিবর্তন করে দেয়, তা সত্য। তাই সবার একই আকাক্সক্ষা ভালো কলেজে ভর্তি হওয়া। কিন্তু যে সংখ্যক জিপিএ-৫ এবছর শিক্ষার্থীরা পেয়েছে সবার জন্য ভালো কলেজে ভর্তি হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিশেষ করে যারা গ্রামে তাদের ফলাফলের করুণ অবস্থা। কারণ শহরে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা সে রকম সুবিধা গ্রাম বা মফস্বল শহরগুলোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই। তাই গ্রামের শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে থাকে নানা দিক দিয়ে। তাই বলে গ্রামের শিক্ষার্থীদের মেধা কম, সেটা বলা যায় না। সঠিক দিকনের্দেশনা ও সুযোগ-সুবিধা পেলে তারা ভালো ফলাফল করত। নিঃসন্দেহে বলা যায়। এ অবস্থায় জেলা ও জেলার বাইরের মফস্বল এলাকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মানোন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
যারা জিপিএ-৫ পেয়েছে তাদের বেশিরভাগই শহরের। কারণ তাদের কোচিং-প্রাইভেটের মাধ্যমে সেভাবে তৈরি করা হয়েছে। শহরের স্কুলগুলোতে সুযোগ-সুবিধাও বেশি। তাই তারা ভালো ফলাফল করছে। সীমিত সুবিধা নিয়ে তারা চেষ্টা করছে ভালো করার। একটা গ্রামের ছেলের সঙ্গে শহরের ভালো স্কুলের ছেলের মধ্যে মেধার কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য হলো শুধুই সুযোগ-সুবিধার। তাই এ মেধাবীদের সামনে এগিয়ে নিতে গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক মানোন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
গ্রামের প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ শিক্ষকের অভাব, বিশেষ করে ইংরেজি ও বিজ্ঞান বিষয়ে ভালো শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা শহরের ভালো প্রতিষ্ঠানমুখী হয়। ফলে শহরের মানসম্মত প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য ভিড় বাড়ে। তাই মফস্বলের স্কুলগুলোর মান কীভাবে বাড়ানো যায়, সে চেষ্টা করা উচিত সরকারের। যদি মফস্বলে সার্বিক সুবিধা দেওয়া যায়, তাহলে শহরমুখী শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেমন কমবে, তেমনই শহর-গ্রামের যে বৈষম্য সেটাও দূর হবে। গ্রামের শিক্ষার্থীরাও এগিয়ে যাবে। দৃঢ়চিত্তে আবারও বলতে চাই, গ্রাম আর শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পার্থক্য শুধু সুযোগ-সুবিধার, মেধার নয়। তাই তাদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। সুন্দর-সুষ্ঠু পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা পেলে তারাও এগিয়ে যাবে। গ্রামের শিক্ষা যথার্থভাবে এগিয়ে গেলই সত্যিকারভাবে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। হ
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
কুমিল্লা