ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার এক মাস পেরিয়ে গেল। ৬ এপ্রিল রাফির গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। চার দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট থেকে চলে যান না ফেরার দেশে। ১১ এপ্রিল জানাজা শেষে সামাজিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। মর্মান্তিক এ মৃত্যুর ঘটনা নাড়া দেয় গোটা দেশের মানুষকে। স্থান পায় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। নুসরাতের চিকিৎসা ও হত্যার বিচারে এগিয়ে আসেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নুসরাতের বড় ভাই মামলার বাদী মাহমুদুল হাসান নোমানকে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরিও দিয়েছেন। ওই চাকরিতে নোমান যোগদানও করেছেন। চাকরি পেয়ে ও নুসরাতের মামলার দায়িত্ব নেওয়ায় নোমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন।
১০ এপ্রিল আলোচিত এ হত্যাকা-ের এক মাস পূর্ণ হলো। এ এক মাসে মামলার আসামিরা ধরা পড়েছেন পিবিআইয়ের (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) জালে। এখন অপেক্ষা মামলার চার্জশিট দাখিলের। পিবিআই বলছে, মামলার অগ্রগতি সন্তোষজনক। এ মাসেই তারা চার্জশিট দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। নুসরাতের পরিবার বলছে, দ্রুত বিচার আইনে দোষীদের শাস্তি হোক। এ রায়ের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হোক যেন আগামীতে কেউ নুসরাতের মতো নির্যাতনের শিকার না হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক মো. শাহ আলম জানান, ৮ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩ এর ৪(১)/৩০ এর আলোকে মামলা করেন নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। পুলিশ হেডকোয়ার্টারের নির্দেশক্রমে পিবিআই মামলার তদন্ত গ্রহণ করে ১০ এপ্রিল।
তদন্ত গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমারের নির্দেশে ফেনী ইউনিটসহ পিবিআই হেডকোয়ার্টার্স, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম মেট্রো ও পিবিআই নোয়াখালী ইউনিট দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে দ্রুত সময়ে ঘটনার নির্দেশদাতা, পরিকল্পনাকারী, অর্থদাতা, মদদদাতাসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তার করে। তিনি জানান, মামলায় এজহারভুক্ত আটজনসহ ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন ১২ জন। মামলার আলামত হিসেবে কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারী শাহাদাত হোসেন শামীম, জোবায়ের হোসেন ও উম্মে সুলতানা পপির পরিহিত তিনটি বোরকা, ঘটনায় কেরোসিন ঢালার কাজে ব্যবহৃত একটি গ্লাসসংশ্লিষ্ট আলামত হিসেবে সংগ্রহ করা হয়েছে। মামলার সুরতহাল প্রতিবেদন, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, নুসরাতের মৃত্যুকালীন জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও কিছু আলামত বিশেষজ্ঞের মতামতের জন্য পাঠানো হয়েছে। মামলার ডকেটিংসহ আনুষঙ্গিক কিছু কাজ শেষে শিগগিরই আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে।
তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, এ মামলায় এখন পর্যন্ত ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদদৌলা, কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম, শিক্ষক আবছার উদ্দিন, নুসরাতের সহপাঠী আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, কেফায়াত উল্লাহ জনি, মোহাম্মদ আলা উদ্দিন, শাহিদুল ইসলাম, অধ্যক্ষের ভাগনি উম্মে সুলতানা পপি, জাবেদ হোসেন, জোবায়ের আহমেদ, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, মো. শামীম, কামরুন নাহার মনি, আবদুর রহিম ওরফে শরিফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, এমরান হোসেন মামুন, মহিউদ্দিন শাকিল, হাফেজ আবদুল কাদের, জান্নাতুল আফরোজ মনি এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ওই মাদ্রাসার সাবেক সহ-সভাপতি রুহুল আমিন।
এ মামলায় ১২ জন আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা হলেন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদদৌলা, নুসরাতের সহপাঠী অধ্যক্ষের ভাগনি উম্মে সুলতানা পপি, জাবেদ হোসেন, জোবায়ের আহমেদ, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, কামরুন নাহার মনি, আবদুর রহিম ওরফে শরিফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, এমরান হোসেন মামুন, মহিউদ্দিন শাকিল ও হাফেজ আবদুল কাদের।
এদিকে এ হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে আরও কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এর মধ্যে রয়েছেন সোনাগাজী মডেল থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। এরই মধ্যে তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে থানা থেকে। সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে। নুসরাতের ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়ে তার বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করেছেন অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হক সুমন। ওই মামলায় ওসিকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে আসছে বিভিন্ন মহল।
এদিকে নুসরাতের পরিবারের বিপক্ষে এবং ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের পক্ষে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি দেওয়ায় আলোচনায় উঠে আসছে ফেনীর পুলিশ সুপার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকারের নাম। ঘটনায় অবহেলা করার দায়ে নুসরাতের পরিবারের অভিযোগের তীর ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পিকেএম এনামুল করিমের দিকে। এসব অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির দাবি করে আসছে বিভিন্ন প্রতিবাদী মহল।
যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী জোটের আহ্বায়ক শিবলী হাসান বলেন, শ্লীলতাহানির মামলা করার পর পাশে না দাঁড়িয়ে স্থানীয় প্রশাসন উল্টো নুসরাত জাহান ও তার পরিবারকে ভয় দেখিয়েছিল। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ, দায়ী সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
মামলার বাদী নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, আমরা এ পর্যন্ত মামলার অগ্রগতি নিয়ে আশাবাদী। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে চার্জশিট দিতে গিয়ে যাতে কোনো আসামির নাম বাদ পড়ে না যায় সেজন্য পিবিআইকে সচেতন থাকার অনুরোধ করছি। নোমান আরও বলেন, চার্জশিট থেকে যদি কোনো আসামি কিংবা পরিকল্পনাকারীর নাম বাদ পড়ে যায় তাহলে আদালতে চার্জশিটের বিরুদ্ধে না রাজি দেব। ২৭ মার্চ নুসরাতকে যৌন নিপীড়নের দায়ে ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাকে আটক করে পুলিশ। পরে ৬ এপ্রিল ওই মাদ্রাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের সহযোগীরা তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত।