আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১১-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার

হাত বদলালেই দাম দ্বিগুণ

নিজস্ব প্রতিবেদক
| প্রথম পাতা

ঢাকার পাশের জেলা মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার রঘুনাথপুরের মরিচ চাষি মো. শাহজাহান স্থানীয় পাইকারি বাজারে নিজের ক্ষেতের মরিচ বিক্রি করছেন প্রতি কেজি ১০ থেকে ১২ টাকায়। জমি থেকে মরিচ তোলায় শ্রমিকের মজুরি, যানবাহন, আড়তদারের কমিশন এবং প্রায় ২ মাসের পরিচর্যার হিসাব করলে এ দামে তার উৎপাদন খরচ তোলা কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ শাহজাহানের মতো চাষিদের এ মরিচই রাজধানীর খুচরা বাজারের ক্রেতাকে কিনে খেতে হয় ৬০ থেকে ৮০ টাকা দরে। শুধু মরিচই নয়, অধিকাংশ সবজির ক্ষেত্রেই এমন চিত্র দেখা যায়। শ্রম ও মূলধন খাটিয়ে ফসল চাষ করে চাষিরা লোকসান দিলেও ক্রেতার পকেট কেটে নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। শুধু হাত বদলালেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন দ্বিগুণে। আর কোনো উৎসব বা উপলক্ষ পেলে পকেট কাটার পরিমাণও বাড়িয়ে দেন তারা।

তেমনি রমজান মাসে চাহিদা বেশি থাকে এমন কয়েকটি সবজির ক্ষেত্রে দেখা গেছেÑ উৎপাদন পর্যায়, পাইকারি ও খুচরা বাজারে দামে বিস্তর ফারাক। আবার কিছু মুদি পণ্যের পাইকারি ও খুচরা মূল্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। এমনকি চাহিদার তুলনায় ঢের বেশি পণ্য সরবরাহ থাকলেও বেড়েই চলেছে দাম। তবে বরাবরের মতোই পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা পরস্পরকে দোষারোপ করেন।

শুক্রবার রাজধানীর পাইকারি সবজির বাজার কারওয়ানবাজারে গিয়ে দেখা গেছে, এ বাজারে সব সবজিই বিক্রি হয় পাল্লা (৫ কেজি) হিসেবে। বাজারটিতে প্রতি পাল্লা মরিচ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকায়। এ হিসেবে প্রতি কেজির দাম ২৪-২৫ টাকা। পাইকারি বাজারের ২০০ গজ দূরের খুচরা বাজারেই এক পোয়া মরিচ বিক্রি হচ্চে ১৫-২০ টাকায়, একই দাম রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে। অর্থাৎ চাষি শাহজাহানের ১০ টাকার মরিচ ক্রেতারা প্রায় ৮ গুণ বেশি দাম দিয়ে খাচ্ছেন ৮০ টাকায়।

রোজায় ব্যবহার ও চাহিদার শীর্ষে থাকা সবজি বেগুনেরও একই অবস্থা। নরসিংদীতে কৃষক পর্যায়ে মান ও জাতভেদে বেগুনের মণ বিক্রি হয় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা, প্রতি কেজি ১৩ থেকে ১৮ টাকা। কিন্তু এ বেগুন পাইকারিতে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে পাল্লা বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকায়, কেজি ২৪ থেকে ৩০ টাকা। আরও এক হাত ঘুরে সে বেগুন ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। চাষি পর্যায় থেকে সংগ্রহ করা ১০ টাকার টমেটোও পাইকারিতে ১৫ থেকে ১৬ টাকা এবং খুচরা ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

নরসিংদীর জঙ্গি শিবপুর, বারৈচা ও পালপাড়া পাইকারি সবজির বাজারে প্রতি মণ শসা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, কেজি ১৩ থেকে ১৫ টাকা; করলার মণ ৮০০ টাকা, কেজি ২০ টাকা, কাঁকরোলের মণ ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা, কেজি ২৩ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কারওয়ানবাজারে পাইকারিতে প্রতি কেজি শসা ২০ থেকে ২২ টাকা এবং কাঁকরোল ২৮ থেকে ৩০ টাকা এবং ও করলা বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা দামে। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে যাথাক্রমে ৪০ থেকে ৫০, ৬০ থেকে ৭০ এবং ৫০ থেকে ৬০ টাকা দামে।
আবার ইফতারে ব্যবহৃত ধনেপাতা বাদ নেই এ তালিকা থেকে। শীত মৌসুমে প্রতি মণ ধনেপাতা কৃষক পর্যায়ে দাম ছিল ২০০ টাকার মতো। এখন রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি ধনেপাতা বিক্রি হচ্ছে একই দামে। কাওয়ানবাজারে প্রতি কেজি ধনেপাতার পাইকারি দাম রয়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। তবে খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ২০০ টাকা দামে।
কারওয়ানবাজারের সবজির পাইকার মো. নজরুল ইসলাম বলেন, যে কোনো সবজির পাইকারি ও কৃষক পর্যায়ের দামে তেমন পার্থক্য থাকে না। পণ্য কেনা ও পরিবহন খরচ বাদে কেজিতে ১ থেকে ২ টাকা লাভেই পাইকাররা পণ্য বিক্রি করে দেন। দাম যা বাড়ানোর তা বাড়ায় খুচরা দোকানিরা। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজিতে ১ টাকা বাড়লেই তারা খুচরায় কেজিতে ১০ টাকা বাড়িয়ে দেন।
আলুর পাইকারি বিক্রেতা মাসুদ রানা বলেন, তিনি প্রতি পাল্লা আলু বিক্রি করছেন ৭৫ টাকা দামে, কেজি ১৫ টাকা। কৃষক পর্যায়ে যা কেনা পড়েছে ১২ টাকায়। তবে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০-২২ টাকায়।
এদিকে মুদি পণ্যের পাইকারি ও খুচরা দামে রয়েছে বেশ ফারাক। বিশেষ করে রাজধানীর শ্যামবাজারের পাইকারি দামের প্রায় দ্বিগুণ দামে খুচরা ও মুদি দোকানে বিক্রি হচ্ছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য পেঁয়াজ। শ্যামবাজারে শুক্রবার প্রতি কেজি ভালো মানের দেশি পেঁয়াজ ১৭ থেকে ১৯ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ১৪ থেকে ১৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে; কিন্তু খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায়, আর আমদানি করা বড় পেঁয়াজের দাম ৩০ টাকা।
শ্যামবাজারের পেঁয়াজের পাইকারি ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক ওয়াহিদ হাসান রনি বলেন, বাজারে এখন পেঁয়াজের প্রচুর সরবরাহ রয়েছে। এর সিংহভাগই দেশি পেঁয়াজ। সবচেয়ে ভালো মানের পেঁয়াজও বিক্রি হচ্ছে ১৯ টাকা প্রতি কেজি। বরং বাজারে প্রচুর সরবরাহ থাকলেও সে অনুপাতে বিক্রি নেই। সে হিসেবে পাইকারি দামের দ্বিগুণ দামে খুচরা বাজারে বিক্রি হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না।
শ্যামবাজারে পাইকারিতে ভালো মানের ৫০ কেজির প্রতি বস্তা ছোলা বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৮০০ টাকায়, প্রতি কেজি ৭৬ টাকা। খুচরায় যা বিক্রি হয়েছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকা দামে। আর প্রতি বস্তা মধ্যম মানের ৩ হাজার ২০০ টাকার ছোলার কেজি বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। পাইকারিতে সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে দুই টাকা কমেছে চিনির দাম। পাইকারিতে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ২ হাজার ৪০০ টাকা বা প্রতি কেজি ৪৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া চিনি খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৫৬ টাকায়।
তেলের বাজারে বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১০২ টাকা, দুই লিটার ২০২ টাকা এবং পাঁচ লিটার ৫০০ টাকা। কোম্পানির সরবরাহ মূল্য এক লিটার ৯০ টাকা, দুই লিটার ১৭৮ ও পাঁচ লিটার ৪৪৫ টাকা।
পাইকারি ও খুচরা দামের পার্থক্য সম্পর্কে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দামের এ পার্থক্য হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে। তাদের অতি মুনাফার কারণেই খুচরায় দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়। আবার খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে কম বিক্রি করে বেশি লাভের মানসিকতাও দাম বাড়ার অন্যতম কারণ। এজন্য ভোক্তাকে সচেতন হতে হবে। এর মধ্যে গরুর মাংসসহ বেশকিছু পণ্য রয়েছে যেগুলোর দাম অনেক চড়া। এখন ভোক্তা যদি গরুর মাংস কেনার পরিমাণ কমিয়ে দেয় বা বেশি দামে পণ্য না কেনে, তবে বাধ্য হয়ে বিক্রেতাকে দাম কমিয়ে দিতে হবে। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের নজরদারি বাড়ানোই এর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হতে পারে। অতি মুনাফালোভীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।