আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১২-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

গ্রামীণ অর্থনীতিতে ছাগল পালনের গুরুত্ব

নিতাই চন্দ্র রায়
| সম্পাদকীয়

দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ এখনও গ্রামে বাস করে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে গাবাদিপশু পালনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গবাদিপশুর মধ্যে ছাগল ও ভেড়া পালনকারীদের ৭০ শতাংশ হচ্ছে ভূমিহীন, প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও দরিদ্র কৃষক। ছাগল পালনের মাধ্যমে সমাজের অল্প আয়ের লোকজনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং গ্রামীণ নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। অন্য গবাদিপশুর তুলনায় ছাগল পালন অনেক সুবিধাজনক। ছাগল পালন করে কম পুঁজিতে, অল্প সময়ে অধিক আয় করা যায়। ছাগলের খাবার খরচও কম। ছাগল ঘাস, লতাপাতা, ভাতের ফেন, তরিতরকারি ও ফলের খোসা, চালের কুঁড়া, গমের ভুসি প্রভৃতি খাদ্য খেয়ে বেঁচে থাকে। কাঁঠাল পাতা ছাগলের প্রিয় খাদ্য। যে গ্রামে বেশি ছাগল পালন করা হয়, সেই গ্রামে কাঁঠাল গাছ থাকে না। থাকলেও গাছে পাতা দেখা যায় না। মানুষ বলে ছাগলের মুখে বিষ। ছাগল শাকসবজি, দানাশস্য ও ফলফুল, গাছের পাতা খেয়ে নষ্ট করে ফেলে। মাঠের ফসল খাওয়াকে কেন্দ্র করে গ্রামাঞ্চলে ছাগল পালনকারীদের সঙ্গে জমির মালিকদের ঝগড়া-বিবাদ এবং সেই ঝগড়া থেকে মামলা-মোকদ্দমা ও সম্প্রীতি বিনষ্টের বহু নজির আছে গ্রামবাংলায়। মাঠের ফসল খেলে অনেকে ছাগল ধরে খোঁয়াড়ে দেয়Ñ এ নিয়েও গ্রামের মানুষের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়।
সংখ্যার দিক থেকে ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। আর ছাগলের মাংস উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। বিশ্ববাজারে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়া ‘কুষ্টিয়া গ্রেড’ নামে পরিচিত। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, সারা দেশের ঘরে ঘরে পালিত ছাগলের সংখ্যা ২ কোটি ৫৪ লাখ ৩০ হাজার, যার প্রায় ৯৫ শতাংশই ব্ল্যাক বেঙ্গল। দেশের প্রায় এক কোটি লোক ছাগল পালন করেন। বাংলাদেশের সব জেলায় কমবেশি ছাগল পালন করা হলেও চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুরে বেশি ছাগল পালিত হয়। ওয়েব ফাউন্ডেশনের হিসাবে, শুধু চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও রাজশাহীতে ২০ হাজার খামারে প্রায় ৫০ লাখ ছাগল লালনপালন করা হচ্ছে। ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় ১০ থেকে ১২ হাজার পরিবার ৩৫ হাজার ছাগল প্রতিপালন করছে। একক কোনো প্রাণী পালনের ক্ষেত্রে এটাই সর্বোচ্চ রেকর্ড। গত ৫ বছরে দেশে ৬০ লাখ ছাগল উৎপাদিত হয়েছে। 
বাংলাদেশের এ জাতটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং ডিএনএ পরীক্ষা করে দীর্ঘ নয় বছর গবেষণা করেছে জাতিসংঘের আণবিক শক্তিবিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। ২০০৭ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সংস্থা দুটি বিশ্বের ১০০ জাতের ছাগলের ওপর গবেষণা করে ব্ল্যাক বেঙ্গলকে অন্যতম সেরা জাত হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। এফএও এবং আইএইএর ওই সমীক্ষার সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা বলছেন, অন্য ৯৯ জাতের সব ধরনের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তুলনা করলে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলই সবার সেরা। বাংলাদেশে এ ছাগলের নবজাতকের মৃত্যু হার অনেক কম। প্রজননে উর্বর ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল প্রতিবার দুই থেকে তিনটি করে বছরে চার থেকে ছয়টি বাচ্চা দেয়। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলোÑ এটি পালন করতে কোনো চারণভূমির প্রয়োজন হয় না। বাড়ির উঠান বা রান্নাঘরের পাশের ছোট স্থানেও এরা দিব্যি বেড়ে ওঠে। তবে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের দুর্বল দিক হলোÑ এর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-ওজন এবং দুধের পরিমাণ অন্য জাতের ছাগলের তুলনায় খুব কম। আফ্রিকার মাসাই, ভারতের যমুনাপাড়ি ছাগল ও চীনের ছাগলের মাংস ও দুধের পরিমাণ ব্ল্যাক বেঙ্গলের চেয়ে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি। তবে ওই তিন জাতের ছাগলের ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ বাচ্চা জন্মের পরপরই মারা যায়। কিন্তু ব্ল্যাক বেঙ্গলের বাচ্চার মৃত্যুর হার ৫ থেকে ১০ ভাগ। এক বছর বয়সের একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল খাসির ৬ থেকে ৮ কেজি মাংস পাওয়া যায়। প্রতি কেজি মাংসের দাম ৭০০ টাকা হলে এক বছর বয়সের একটি খাসির দাম দাঁড়ায় ৪ হাজার ২০০ থেকে ৫ হাজার ৬০০ টাকা। অন্যদিকে বগুড়া সদরের বানদিঘি পূর্বপাড়ার ছাগলের খামারি আলহাজ আবদুল হান্নানের মতে, একটি ছাগল পরিপূর্ণ হতে ১৪ মাস সময় লাগে। এ ১৪ মাস ঠিকমতো লালনপালন করলে খাসির ওজন দাঁড়ায় ১৬ থেকে ১৭ কেজি, যা বিক্রি করে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গবেষণা করে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ২, ৩ বা ৪টি ছাগল পালন করে বছরে গড়ে যথাক্রমে ৩ হাজার ১৫০, ৪ হাজার ১৫০ও ৫ হাজার ৩৭৩ টাকা আয় করা সম্ভব।
গ্রামাঞ্চলে অনেক ছেলেমেয়ে আছে, যারা ছাগল পালন করে পড়াশোনার খরচের টাকা জোগাড় করে। পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় অনেক গরিব ঘরের ছাত্রছাত্রীরা ছাগল বিক্রি করে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করে। বিপদাপদে ও অসুখে-বিসুখে এ ছাগল বিক্রির অর্থই গ্রামের গরিব মানুষের একমাত্র অবলম্বন হয়ে থাকে। ছাগলের মলমূত্র ফসলের জমিতে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়া থেকে উন্নতমানের জুতা, ব্যাগসহ নানা রকম পণ্য প্রস্তুত করা হয়।
ছাগল পালন প্রযুক্তির দিক থেকেও বাংলাদেশ বেশকিছু সফলতা অর্জন করেছে। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ২০০৮ সালে মাচায় ছাগল পালনের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন এবং ছাগলের মৃত্যু কমানোর জন্য ‘লিফট’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ওয়েব ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা ওই প্রকল্পের ছাগলের মৃত্যু হার চুয়াডাঙ্গা জেলায় গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০ থেকে ৫ শতাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এ সময় চুয়াডাঙ্গা জেলায় ছাগলের সংখ্যাও বেড়েছে ৩০ শতাংশ এবং সারা দেশে উপজেলাপ্রতি ছাগলের সংখ্যা গড়ে ১৭১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণত মূত্র পায়ে লেগেই ছাগলের ক্ষুরা রোগ হয় এবং জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। মাচা পদ্ধতিতে মূত্র নিচে পড়ে যায় বলে এ রোগের প্রকোপ কমে যায়।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জাত উদ্ভাবনে গবেষণা চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। দেশীয় জাতের এ ছাগলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন সহজ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ৪৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি। প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় দেশের ৬টি জেলায় ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হবে। জেলাগুলো হলোÑ ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, মেহেরপুর, বান্দরবান, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা। এরই মধ্যে প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি প্রকল্প প্রস্তাবের ওপর মূল্যায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় প্রকল্পটি প্রাথমিকভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় উপস্থাপন করা হবে বলে জানা যায়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তরা জানান, সম্ভাবনাময় জেনেটিক সম্পদ হিসেবে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে ছাগল মূলত মাংস ও চামড়ার জন্য বিখ্যাত। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল ক্ষুদ্র খামারিদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। দেশে পালিত অধিকাংশ ছাগলই ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের। এছাড়া ভারতের যমুনাপাড়ি নামের (রাম ছাগল) অল্প পরিমাণে কিছু উন্নত জাতের ছাগল পালন করা হয় বাংলাদেশে। এসব ছাগল থেকে অধিক পরিমাণ মাংস পাওয়া যায় এবং পালন খরচও তুলনামূলক বেশি। তবে যমুনাপাড়ি জাতের ছাগলের মাংসের চেয়ে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের মাংসের স্বাদ ও দাম বেশি। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনে সহজ প্রযুক্তিগুলো মাঠ পর্যায়ে হস্তান্তর করা সহজ হবে। এতে দেশীয় ছাগল সংরক্ষণ সহায়ক হবে এবং সংখ্যা বাড়বে। এর মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং নারী ও তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। 
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তরা জানান, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ওপর ভিত্তি করে মাথাপিছু সরবরাহ নিশ্চিত করতে এরই মধ্যে ধান উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয়েছে। বৃদ্ধি করা হয়েছে শাকসবজি ও ফলমূলে উৎপাদন। কিন্তু প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। গুণগত মানসম্পন্ন আমিষের প্রধান উৎস হলো গবাদিপশু। আমিষের অভাব মানুষের শারীরিক ও মানসিক মেধা বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। ছাগলের দুধ ও মাংসের মাধ্যমে গুণগত মানের আমিষ পাওয়া যায়। এ কারণে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের এ প্রকল্পটি গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। 
ছাগল পালনে লাভবান হতে হলে ছাগলকে রোগমুক্ত রাখতে হবে। ছাগলের ক্ষতিকারক রোগের মধ্যে পিপিআর, ক্ষুরা রোগ, গোটপক্স, নিউমোনিয়া, এনথাইমা ও ক্রিমি উল্লেখযোগ্য। ছাগলকে রোগবালাই থেকে মুক্ত রাখতে হলে যেসব বিষয়ের প্রতি অবশ্যই যতœবান হতে হবে, সেগুলো হলোÑ এক. ছাগলের ঘর নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে। দুই. ঘর যাতে ভেজা স্যাঁতসেঁতে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তিন. নতুন ছাগল আনার পর অন্তত ৭ দিন আলাদা রাখতে হবে। চার. ছাগলকে সময়মতো টিকা দেওয়া ও কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে। পাঁচ. কোনো রোগের লক্ষণ দেখা দিলে রোগাক্রান্ত ছাগলকে আলাদা রাখতে হবে। ছয়. রোগাক্রান্ত ছাগলকে দ্রুত পশু চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। সাত. রোগের কারণে মৃত ছাগলকে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। আট. নিয়মিত ছাগলের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে এবং ছাগলকে সুষম খাদ্য ও পানি সরবরাহ করতে হবে।
দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে ছাগল পালনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে পারে। ছাগল ভূমিহীন কৃষক ও দুস্থ নারীদের আত্মকর্মসংস্থানে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। পিপিআর রোগের কারণে প্রতি বছর দেশে অনেক ছাগল মারা যায়। তাই সরকারি পশু হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে এ রোগের টিকা সরবরাহ এবং ছাগল পালনের জন্য স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে ছাগল পালনকারীদের সুরক্ষার জন্য পশুবিমা প্রচলন এবং বিমার কিস্তির টাকা ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করতে হবে। হ

নিতাই চন্দ্র রায়
পরিচালক, কৃষি প্রযুক্তি কেন্দ্র
ত্রিশাল পৌরসভা, ময়মনসিংহ