গ্রামের নাম আলতাপোল। যশোরের কেশবপুর থানা শহর থেকে স্বল্প দূরত্বের এলাকাটি অপেক্ষাকৃত নিচু। বর্ষা মৌসুমে মাঠ-ঘাট ডুবে থাকে দীর্ঘ সময়। ফসলও ঠিকমতো হয় না। কাজের অভাবে অলস সময় পার করতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের। তবে অলস বসে থাকলে তো আর সংসারের চাকা ঘুরে না। জীবন-জীবিকার তাগিদে তখন ভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তারা। এই ভিন্ন পেশা হিসেবে কাঠের শোপিস তৈরি করে তা বাজারজাত শুরু করেন শাহানা। গাছের চিকন ও স্বল্প মোটা ডাল শুকিয়ে তা মেশিনে প্রক্রিয়া করে দৃষ্টিনন্দন শোপিস তৈরি করেন শাহানা। আর এই কাজ করেই স্বাবলম্বী হয়েছেন তিনি।
গৃহবধূ শাহানা বেগম সংসারের অভাব দূর করতে প্রায় ১৫ বছর ধরে কাঠের শোপিস তৈরি করে চলেছেন। স্বামী, এক ছেলে আর দুই মেয়ের সংসারে এনেছেন সচ্ছলতা। আখের চাষ, মাছের ঘের আর গরু পালনের পাশাপাশি সেলাই মেশিনও চালান তিনি। স্বামী আবদুল মালেক ফার্নিচারের রং মিস্ত্রির কাজ করেন। ফলে আগের মতো এখন অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় না তাকে। শাহানা নিজ হাতেই মেশিনে তৈরি করছেন কাঠের নান্দনিক শোপিস। বর্তমানে শাহানা ছাড়াও এই গ্রামের বহু মানুষ কাঠের শোপিস তৈরি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করার পাশাপাশি সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন।
শাহানা জানান, নিজেদের দুই বিঘা জমি থাকলেও চাষাবাদ ভালো হতো না। ফলে সংসারে অভাব লেগেই ছিল। প্রায় অর্ধযুগ আগে তিনি ভারতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যান। সেখানে শোপিস তৈরির কারখানা দেখে উদ্বুদ্ধ হন। জানতে পারেন, কারখানা তৈরি করতে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা লাগে। কিন্তু অর্থের অভাবে কারখানা দেওয়া হয়নি। তবে মনের ভেতর বাসনা ছিল একদিন তিনি কারখানা দেবেনই। সেই থেকে ২০০৮ সালে ডাম ফাউন্ডেশন ফর ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (ডিএফইডি) এর স্থানীয় ‘দোয়েল’ মহিলা উন্নয়ন দলের সভাপতি নাছিমা বেগমের পরামর্শে দোয়েল দলে ভর্তি হয়ে সঞ্চয় জমাতে থাকেন। এক মাস পর ডাম ফাউন্ডেশন থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে আর ১ বিঘা জমি বন্ধক দিয়ে সর্বমোট ২০ হাজার টাকা জোগাড় করে মা ছেলে মিলে শোপিস তৈরির জন্য কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। কাজ শুরু করেন ছোট পরিসরে।
পরের বছর সমিতি থেকে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে এবং লাভের টাকা দিয়ে মোট ৫০ হাজার টাকায় আরও দুটি মেশিন কিনেন। বর্তমানে তার কারখানায় মোট তিনটি মেশিনে কাজ হয়। ডিএফইডির ঋণ আছে ৩০ হাজারটাকা। শাহানার শোপিস তৈরির কারখানায় মগ, জগ, গ্লাস, ডাল ঘুটনি, খুন্তি, হামানদিস্তা, অ্যাসট্রে, পাউডার কেস, মশলাদানি, চুরির আলনা, চামচ, ডিম সেট, ডাব সেট, আপেল সেট, টাকা রাখার ব্যাংক, পাতিল, হারিকেন, খেলনা সেট, বেলুনপীড়া, ভিআইপি খুন্তি, টিফিন বক্স, হাঁড়ি, কড়াই ইত্যাদি তৈরি করা হয়। সব মিলিয়ে প্রায় দুই থেকে তিনশ’ আইটেম তৈরি করা যায়।
তিনি জানান, বিভিন্ন শোপিস তৈরিতে আম, জাম, কাঁঠাল, সেগুন, মেহগনি প্রভৃতি কাঠের প্রয়োজন হয়। এসব কাঠের দামও তুলনামূলকভাবে কম। স্থানীয় ২৩ মাইল এলাকা থেকে কাঠ কিনে তা শুকিয়ে কারখানায় বিভিন্ন ধরনের ও আকারের শোপিস তৈরি হয় মুহূর্তের মধ্যেই। শোপিসগুলো আকারভেদে ২০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। এই কাঠের শোপিস বিপণন হয় যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, মাগুরা, নড়াইল, ফরিদপুর, ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায়। শোপিস তৈরি প্রক্রিয়ায় প্রচুর পরিত্যক্ত কাঠ বের হয়। যা পরবর্তীকালে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এই ব্যবসা করেই শাহানার নগদ পুঁজি এখন এক লাখ টাকা। বাড়ি তৈরির জন্য কিনেছেন ১৫ কাঠা জমি ও এঁড়ে গরু।
শাহানার কারখানায় অনেক নারী শ্রমিক কাজ করেন। স্থানীয় লতিফের স্ত্রীও শোপিস তৈরির কাজ করেন। তিনি বলেন, অবসরে অলস সময় কাটাই সেই সময়টুকু কাজ করে কিছু অর্থ পাই, মন্দ কী? জানা যায়, বিশ জনের বেশি নারী শ্রমিক তার কারখানায় কাজ করেন। একটি শোপিস তৈরি করতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগে। প্রতিটি শোপিসের জন্য ২ থেকে ১০ টাকা দেওয়া হয়। একজন নারী শ্রমিক গড়ে প্রতি মাসে ১ থেকে ২ হাজার টাকা পান। কাজের সার্বিক বিষয়ে শাহানা বলেন, আমি যে পেশায় নিয়োজিত তা নিয়ে আমি গর্বিত। স্বল্প পুঁজি দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও বর্তমানে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে চাই। এ জন্য আরও আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বর্তমানে সব খরচ বাদে মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা লাভ হয়। এখন নিজের পাকা বাড়ি ও মালামাল পরিবহনে নিজস্ব গাড়ির স্বপ্ন দেখছেন তিনি। কিন্তু বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং আর্থিক স্বল্প পুঁজি বড় বাধা বলে তিনি মনে করছেন। ডিএফইডির কেশবপুর শাখার ম্যানেজার মো. মফিজুল ইসলাম জানান, শাহানা আমাদের পুরনো সদস্য। তিনি নিয়মিত সঞ্চয় জমা করেন এবং ঋণের লেনদেন করে থাকেন। তিনি খুবই পরিশ্রমী। তার শোপিস তৈরির কারখানা দেখে অনেকেই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। তিনি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে স্থানীয়ভাবে বেশ পরিচিতি পেয়েছেন। তার পরিবারের আর্থসামাজিক অবস্থারও পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে শোপিস তৈরি করে সংসারের অভাব দূর করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। সূত্র : ডিএফইডি