আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১২-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

চট্টগ্রাম বন্দর

বাড়ছে ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য আমদানি

সাইফুদ্দিন তুহিন, চট্টগ্রাম
| শেষ পাতা

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য আমদানি আবার বেড়ে গেছে। ২০০৭ সালে ৪০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনারে গার্মেন্ট পণ্যের পরিবর্তে এসেছিল বালু। দেড় যুগের মাথায় আবার কনটেইনার ভর্তি মিলল ইট-বালু। ৭ মে কনটেইনার খুলে ইটের সন্ধান পান কাস্টমস কর্মকর্তারা। এতে তোলপাড় শুরু হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, তদারকির অভাবেই ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য আমদানি হচ্ছে। তবে কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, ঘোষণা বহির্র্ভূত পণ্য আমদানি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তদারকি আছে বলেই এ ধরনের পণ্য চালান ধরা পড়ছে।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার কাজী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গত সাড়ে তিন মাসে ১০টির মতো চালানে আমরা অর্থপাচারের সম্পৃক্ততা পেয়েছি। এছাড়া কিছু দিন আগে দুটি চালানের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে কাগজপত্র পাঠিয়েছি। এনবিআরের অনুমতি পেলেই আমরা মামলা করব। হুইল চেয়ারের ঘোষণায় ইট আসার ঘটনার বিষয়টি আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করছি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আমদানিকারকরা মিথ্যা ঘোষণায় ঋণপত্র (এলসি) খুলে লাখ লাখ ডলার বিদেশে পাচার করছেন। গেল ৭ মে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডে জব্দ করা হয় এরকমই একটি চালান। ওই চালানের আমদানিকারক ঢাকার লোটাস সার্জিক্যাল। এ প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ৭টি হুইল চেয়ার ও ৪৫০ পিস ক্রেচ প্লাস ওয়াকার আমদানির ঘোষণা দেয়। 

নিয়ম অনুযায়ী কাস্টমসে দাখিল করা ইম্পোর্ট জেনারেল মেনিফিস্টে (আইজিএম) পণ্যের বিস্তারিত উল্লেখ থাকে। অথচ তিনটি কনটেইনারের মধ্যে এক কনটেইনারে মাত্র ৪০টি হুইল চেয়ার পাওয়া যায়। বাকি দুটি কনটেইনারে কার্টনভর্তি ইট নিয়ে আসা হয়। সঙ্গে পাওয়া যায় কিছু বালু। ওই চালানটি আমদানি করতে ব্যাংকে ৭১ হাজার ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খুলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। প্রতি ডলার ৮৪ টাকা হিসেবে পণ্য চালানের মূল্য দাঁড়ায় ৫৯ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। গেল চার মাসে ছোট বড় এরকম আরও ১০ থেকে ১১টি চালানে পণ্য আমদানি হয়েছে। এসব চালান আমদানির মাধ্যমে মূলত মানি লন্ডারিংয়ের কাজই হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে চালানগুলোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করা হয়েছে। অর্থ পাচার ঠেকাতে গেল বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার নুর উদ্দিন মিলনকে প্রধান করে ৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করে মানি লন্ডারিং সেল গঠন করা হয়। সেলটি গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত কাজের তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, গেল বছরের ২ আগস্ট শ্রীলঙ্কার কলম্বো থেকে ব্যবহৃত পণ্য ঘোষণা দিয়ে অর্ধকোটি টাকার বিদেশি সিগারেট নিয়ে আসে হবিগঞ্জের ফিরোজ মিয়ার ছেলে মিজান। এছাড়া একই বছরের ৬ মে ৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগে ৬৬ লাখ ৯৪ হাজার শলাকা এবং ২৮ এপ্রিল ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির দায়ে ৭৫ লাখ শলাকা বিদেশি সিগারেট আটক করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এসব পণ্য আমদানিতে মুদ্রা পাচারের সংশ্লিষ্টতা পায় কাস্টম। এছাড়া গেল বছরের ১ সেপ্টেম্বর বালুভর্তি একটি কনটেইনারের চালান আটক করে কাস্টম। ঢাকার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রোগ্রেস লিমিটেড ‘কাগজ’ আমদানির ঘোষণা দিয়ে ৪১০ বস্তা বালু নিয়ে আসে। ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি চীনে ১৫ হাজার ডলার পাচার করেছেÑ এমন অভিযোগ রয়েছে। 
অন্যদিকে ২০১৭ সালের মার্চের দিকে পশুখাদ্য তৈরির মূলধনী যন্ত্রপাতি ঘোষণা দিয়ে চীন থেকে আমদানিকৃত ১২ কনটেইনারের ভেতরে ১৬ হাজার ২৭০ বোতল বিদেশি মদ, ৩ কোটি ৮৪ লাখ শলাকা সিগারেট, ফটোকপি মেশিন ও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দামি এলইডি টেলিভিশন পান কাস্টমস কর্মর্তারা। এসব পণ্যের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার ‘হেনান আনহুই এগ্রো এলসি’ ও কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুরের ‘এগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি’। উভয় প্রতিষ্ঠানেরই মালিক খোরশেদ আলম নামে এক ব্যবসায়ী। আমদানিকারকের পক্ষে পণ্য খালাসের দায়িত্বে ছিল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট রাবেয়া অ্যান্ড সন্স। চালানে রপ্তানিকারক হিসেবে চীনের জমরাজ ইন্ডাস্ট্রিজের নাম উল্লেখ করা হয়। তবে এসব পণ্য জব্দের পর চালানে উল্লেখিত ঠিকানায় আমদানিকারকের খোঁজ নিলে সেখানে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্বই মেলেনি। একইভাবে অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি খালাসের দায়িতপ্রাপ্ত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট রাবেয়া অ্যান্ড সন্সের।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় ৪০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনারে মিলে বালু। পণ্য আমদানিকারকের ঘোষণায় ছিল গার্মেন্টের কাঁচা পণ্য। কিন্তু ঘোষণার সঙ্গে আমদানি পণ্যের কোনো অস্তিত্বই মেলেনি। এ ঘটনায় কাস্টমসে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। পরে নিশ্চিত হওয়া গেছে এসব মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি হয়েছে মুদ্রা পাচারের জন্য।