ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় দায়িত্ব পালনে গাফিলতির প্রমাণ পাওয়ার পর সোনাগাজী মডেল থানার দুই উপপরিদর্শককে (এসআই) সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তারা হলেন এসআই মো. ইউসুফ ও এসআই মো. ইকবাল আহাম্মদ। এ ঘটনায় সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করার পরদিন এ দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়। খবর বিডিনিউজের।
পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, শনিবার সাময়িক বরখাস্ত করে তাদের দূরবর্তী বিভিন্ন ইউনিটে সংযুক্ত করা হয়েছে। সংযুক্তি কোনো বদলি নয়, এটি শাস্তি প্রক্রিয়ার একটি অংশ। সংযুক্তিকালে তাদের কোনো দায়িত্ব প্রদান করা হয় না। পুলিশ সদর দপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে এসআই ইউসুফকে খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয় এবং এসআই ইকবালকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় সংযুক্ত করা হয়েছে। ফেনীর পুলিশ সুপার (এসপি) এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকারের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে এআইজি সোহেল রানা জানান। ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে তাকেও একটি ইউনিটে সংযুক্ত করা হবে। তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন,’ বলেন তিনি।
নুসরাত হত্যার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তদন্ত শেষে পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত দল এসপি ও ওসি মোয়াজ্জেমসহ অন্তত চারজনের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। ডিআইজি এসএম রুহুল আমিনের নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ সদস্যের ওই তদন্ত দল ৩০ এপ্রিল তাদের প্রতিবেদন জমা দেন।
মোয়াজ্জেম হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে রংপুরে ডিআইজির কার্যালয়ে সংযুক্ত করার কথা শুক্রবারই জানিয়েছিলেন এআইজি সোহেল রানা। মোয়াজ্জেম হোসেন আপাতত বেতন-ভাতা ও পদ অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা পাবেন না; শুধু নিয়ম অনুযায়ী খোরাকি ভাতা পাবেন বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদদৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের মামলা তুলে না নেওয়ায় ৬ এপ্রিল কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাতের গায়ে। এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদদৌলাকে প্রধান আসামি করে আটজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত পরিচয় আরও চার থেকে পাঁচজনকে আসামি করা হয় সেখানে। কিন্তু অনেকেই এ ঘটনায় সোনাগাজীর পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতি এবং আসামি ধরতে গড়িমসির অভিযোগ করেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার সময় পরীক্ষা কেন্দ্রে পুলিশ ছিল, তারপরও এরকম ঘটনা কীভাবে ঘটল। দোষীরা কীভাবে পালিয়ে গেল এবং ওই ঘটনার পর আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশের কেন তিন দিন সময় লাগলÑ সেই প্রশ্নও ওঠে। এ পরিস্থিতিতে ১০ এপ্রিল মোয়াজ্জেম হোসেনকে সোনাগাজী থানার দায়িত্ব সরিয়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে বদলি করা হয়। মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় পিবিআইয়ের হাতে। ওইদিন রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নুসরাত। তার ভাইয়ের করা হত্যাচেষ্টা মামলাটি রূপান্তরিত হয় হত্যা মামলায়।
তখন অভিযোগ ওঠে, ঘটনা ভিন্নখাতে নেওয়ার জন্য ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতের মৃত্যুর বিষয়টি ‘আত্মহত্যা’ বলার চেষ্টা করেন।
নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার ওই ঘটনা সারা দেশে ক্ষোভের সৃষ্টি করলেও পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর ঘটনার তদন্তে যথাযথ গুরুত্ব দেননি বলেও অভিযোগ ওঠে। এ প্রেক্ষাপটে অবহেলার পাশাপাশি সার্বিক বিষয় খতিয়ে দেখতে ১৩ এপ্রিল পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত দল গঠন করে দেয় পুলিশ সদর দপ্তর।
এদিকে নুসরাতের মৃত্যুর পরদিন ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, থানায় ওসির সামনে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলে ধরতে গিয়ে অঝোরে কাঁদছেন ওই তরুণী। নিজের মুখ তিনি দুই হাতে ঢেকে রেখেছিলেন।
সে সময় ওসি মোয়াজ্জেম ‘মুখ থেকে হাত সরাও, কান্না থামাও’ বলার পাশাপাশি এও বলেন, ‘এমন কিছু হয়নি যে এখনও তোমাকে কাঁদতে হবে’।
ওই ভিডিও ধারণ এবং তা ফেইসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ায় মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন সৈয়দ সায়েদুল হক নামের এক আইনজীবী। ওই মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য পুলিশকে ২৭ মে পর্যন্ত সময় দিয়েছে বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল।
পৌর কাউন্সিলরসহ চার আসামি রিমান্ড শেষে কারাগারে : সোনাগাজী প্রতিনিধি জানান, ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলায় পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদুর রহমানসহ চার আসামিকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। শনিবার সন্ধ্যায় ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসাইন তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
মাকসুদুর রহমান ছাড়া বাকি তিন আসামি হলেন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ইংরেজির প্রভাষক আফসার উদ্দিন, মোহাম্মদ শামীম ওরফে শামীম ও আরিফুল ইসলাম।