আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১২-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

একজন একাধিক ভাতা নিলে জেল-জরিমানা

সামাজিক নিরাপত্তা আইনের খসড়া

আমিরুল ইসলাম
| প্রথম পাতা

এক ব্যক্তি শুধু একটি সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা পাবেন। কোনো অবস্থাতেই তিনি একাধিক সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা পাবেন না। জনগণের দারিদ্র্য স্কোরভিত্তিক খানাজরিপের ফলের ভিত্তিতে জাতীয় কমিটি সুবিধাভোগী নির্বাচন করতে পারবে। দারিদ্র্যের স্কোর সংক্রান্ত কোনো আপিল বা অভিযোগ থাকলে তা স্থানীয় ইউনিয়ন বা উপজেলা কমিটি যাচাই করে ব্যবস্থা নেবে। এসব বিধিবিধান রেখে সামাজিক নিরাপত্তা আইন নামে একটি আইনের খসড়া প্রণয়ন করছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, যা সামাজিক নিরাপত্তা আইন-২০১৯ নামে অভিহিত হবে। 

আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, উপকারভোগীর কাছে সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধা ডিজিটাল পদ্ধতি মোবাইলে, পোস্টাল ক্যাশ কার্ডে, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে পৌঁছে দেওয়া হবে। কোনো ব্যক্তি মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত সুবিধা গ্রহণ করলে, অন্য কোনো ব্যক্তিকে মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে ভাতা বা সুবিধা পেতে সহযোগিতা করলে, অন্যায়ভাবে কোনো যোগ্য ব্যক্তিকে সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা বা ভাতা পেতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলে, সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা বা সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য উৎকোচ দাবি করলে এবং সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে গাফলতি প্রদর্শন করলে ছয় মাসের কারাদ- এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদ- অথবা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। 

খসড়া আইনটির ওপর এরই মধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মতামত নেওয়া হয়েছে। আইনের খসড়া প্রণয়নের বিষয়টি স্বীকার করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব একে মহিউদ্দিন আহমদ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বিষয়টি এ মুহূর্তে বিস্তারিত বলতে পারব না। পরে কথা বলেন। খসড়া আইনে বলা হয়েছে অন্যান্য আইনে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না কেন এ আইনের আওতায় অপরাধ সংঘটিত হলে মোবাইলকোর্ট আইন-২০০৯ এর অধীন মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করে বিচার করা হবে। তবে এ আইনের অধীনে দেওয়া শাস্তির বিরুদ্ধে দেশে প্রচলিত বিধান মোতাবেক ঊর্ধ্বতন আদালতে আপিল দায়ের করা যাবে। 

চলতি অর্থবছর দেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ২৩টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। তবে এ কার্যক্রম সংক্রান্ত এটিই প্রথম আইন বলে জানিয়েছেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থেকে দরিদ্র মানুষের জন্য সরকার নানা কার্যক্রম গ্রহণ করলেও এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। সামাজিক নিরাপত্তা আইন-২০১৯ হচ্ছে এ সংক্রান্ত আইন, যা এখনও খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন ও তত্ত্বাবধানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা পরিষদ নামক একটি পরিষদ গঠন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও ওই কমিটিতে সাতজন মন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সমন্বয়ক (এডিজি বিষয়ক), প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, অর্থ সচিব এবং সমাজকল্যাণ সচিব থাকবেন। সামাজিক নিরাপত্তার সেবা এবং ভাতা বিতরণ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, অর্থবরাদ্দ নিশ্চিত করা, সামাজিক নিরাপত্তার অভিষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনে অগ্রগতি মূল্যায়ন, দুর্বলতা চিহ্নিত করা, ত্রুটি সংশোধন, পরিমার্জনের নির্দেশনা দেওয়া, বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থাকে সামাজিক নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করা হবে জাতীয় কমিটির কাজ। আইনের অধীনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি (সিএমসিএসএস) থাকবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছাড়াও কমিটিতে ৩৪ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবরা দায়িত্বপালন করবেন। এ কমিটি বছরে দুটি সভা করবে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা সামাজিক নিরাপত্তার ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবেন। 
বিষয়ভিত্তিক ক্লাস্টার গঠন : সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে দক্ষতা বাড়াতে বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পারস্পরিক সহযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য কার্যক্রমের সাদৃশ্যের ওপর ভিত্তি করে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সমন্বয়ে পাঁচটি বিষয়ভিত্তিক ক্লাস্টার গঠন করা হবে। সামাজিক ভাতা ক্লাস্টার, খাদ্য নিরাপত্তা ও দুর্যোগ সহায়তা ক্লাস্টার, সামাজিক নিরাপত্তা ক্লাস্টার, শ্রম ও জীবিকায়ন ক্লাস্টার, মানব উন্নয়ন ও সামাজিক ক্ষমতায়ন ক্লাস্টার। ক্লাস্টারগুলো প্রতি তিন মাস অন্তর একটি সভা করে সভার কার্যবিবরণী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাবে। যেসব মন্ত্রণালয় থেকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ভাতা দেওয়া হয়, সেসব মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের সমন্বয়ে গঠিত হবে ভাতাভিত্তিক ক্লাস্টার। 
এ ক্লাস্টারের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এর আওতায় থাকবে সমাজ কল্যাণ, মহিলা ও শিশু, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং পার্বত্য চট্টাগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ আইনের আওতায় কর্মক্ষম বয়সি মানুষের জন্য বার্ধক্য পেনশন সুবিধা থাকবে; থাকবে বেকার ভাতা, স্বাস্থ্য বিমা, দুর্ঘটনা, পঙ্গুত্ব, মাতৃত্বকালীন ঝুঁকির জন্য সামাজিক বিমার আইনি কাঠামো। গড়ে তোলা হবে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো স্থাপন এবং পরিচালনা ব্যবস্থা পরিবীক্ষণ ব্যবস্থা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ ক্লাস্টারের সমন্বয়কের দায়িত্বপালন করবে। এ আইন কার্যকরের পরপরই সামাজিক বিমা ব্যবস্থা চালুর জন্য সরকারি গেজেট জারি করে একটি জাতীয় সামাজিক বিমা কর্তৃপক্ষ নামে একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে।
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, সব সময় মানুষের জন্য গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্যের পর্যাপ্ত উৎপাদন ও জোগান নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা ও দুর্যোগ ত্রাণবিষয়ক সামাজিক নিরাপত্তা ক্লাস্টারে খাদ্য মন্ত্রণালয় হবে ক্লাস্টার প্রধান সমন্বয়ক। খাদ্য মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, কৃষি মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। শ্রম ও জীবিকায়ন ক্লাস্টারের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্বপালন করবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। 
মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সামাজিক ক্ষমতায়ন ক্লাস্টারের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট থাকবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। প্রশাসনিক বিভাগে বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে বিভাগীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি, জেলা পর্যায়ে ডিসির নেতৃত্বে জেলা ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং উপজেলা পর্যায়ে ইউএনওর নেতৃত্বে উপজেলা ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকবে। উপজেলা ব্যবস্থাপনা কমিটি অতি বৃদ্ধ, দুস্থ এবং দরিদ্র মানুষকে তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সামাজিক নিরাপত্তার স্থানীয় তহবিল থেকে বা অন্য কোনো নিয়মিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত এনজিও সুশীল সমাজের কার্যকর সমন্বয় এবং সহযোগিতার আনুষ্ঠানিক প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য ৩০ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হবে। কমিটির প্রধান হবেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার)। দেশের সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধাভোগী বা প্রত্যাশী জনগণের অভিন্ন পরিচিতি নম্বর থাকবে। দারিদ্র্য স্কোর এবং অন্যান্য মৌলিক উপাত্তের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল তথ্য ভা-ার থাকবে। অন্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন এ আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর বিধানাবলী প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে।