আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১৫-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

জিপিএ’র সমুদ্রে হাবুডুবু!

অরুণ কুমার বিশ্বাস
| সম্পাদকীয়

শিক্ষার জমিনে প্রচুর ফলন হয়েছে এবার। ১ লাখের ওপরে শুধু জিপিএ-৫ পেয়েছে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা। আমি ইতিবাচক মানুষ, ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হলে তাতে দেশের আদতে কোনো ক্ষতি নেই, বরং লাভ আছে। কারণ কাউকে ঘায়েল করার জন্য ঘাড়ে কোপ মারলেও একজন শিক্ষিত ঘাতক শানিত এবং মরিচাবিহীন ছোরা ব্যবহার করবে, কারণ সে জানে ছোরায় মরিচা থাকলে তাতে ধনুষ্টংকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর একজন অকাট্য মূর্খ না বুঝেশুনে হাতের কাছে যা পাবে; তা দিয়েই আঘাত করবে। কারণ তার জ্ঞানের ঘাটতি আছে। 
ইয়েস, প্রশ্নটা আমার এখানেই। জ্ঞান। আমাদের জমিনে প্রচুর ফসল ফলেছে সে ঠিক আছে; কিন্তু তা কী ধান, নাকি চিটা! চিটা শব্দের আভিধানিক অর্থ অপুষ্ট না অপরিণত ধান। চিটায় ওজন কম, খাওয়া যায় না বা খেলেও পুষ্টি হয় না, মরীচিকার মতো অকারণ শুধু আশা জাগায়, কাজের কাজ কিচ্ছু হয় না। 
এই যে এত এত ভালো ছাত্রছাত্রী, তাদের প্রকৃত জ্ঞান কতটুকু অর্জিত হলো, সেই হিসাব কি আছে! সেদিন আমার এক আত্মীয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সম্প্রতি এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে, তার ছেলে সোনালি জিপিএ পেয়েছে, তাতে বাবা হিসেবে তার বড্ড পায়াভারী। তিনি কথায় কথায় বগল বাজান আর বলেন, তার ছেলে একেবারে যাকে বলে জুয়েল। স্বর্ণরেণু যাকে বলে। চব্বিশ ক্যারেট সোনা, কোনো খাদ-খামতি নেই। 
বেশ কথা। কৌতূহলবশত হাতের ইশারায় ছেলেটিকে আমি কাছে ডাকলাম। ছাত্রের জ্ঞান ও গুণের বহর সম্পর্কে সম্যক ধারণালাভের উদ্দেশ্যে বলি, বলো তো বাপু, সূর্য পূর্বদিকে ওঠে আর পশ্চিমে অস্ত যায়, ইংরেজিটা কী হবে! 
প্রায় মিনিট চারেক ভাবল সে, তারপর তো তো করে কোনোমতে বলল, সান জাম্পস ...। আমি বললাম, থাক, আর দরকার নেই। তোমার সূর্য অনেক লাফিয়েছে। লাফাতে লাফাতে বেচারা টায়ার্ড হয়ে গেছে, আর তোমার কপালেও স্বেদবিন্দু অর্থাৎ ঘাম ঝরছে। এবেলা ক্ষান্ত দাও। 
আর্টিকেল জানে না এ ছেলে। সূর্যের আগে দ্য বসে, ধারণা নেই। ওর সূর্য ওঠে না, জাম্প করে। ছেলের বাপ কাছেই ছিলেন। তিনি একটু অস্বস্তিতে ভোগেন। তার স্বর্ণরেণু হাওয়ায় উড়তে শুরু করে। মিনমিনে গলায় বললেন, দেখুন দাদা, ইংরেজিটাই তো সব নয়। ব্রিটিশরা আমাদের কম জ্বালিয়েছে নাকি! আমার ছেলে বড্ড দেশপ্রেমিক, ইংরেজিটা তাই সে শিখতেই চায় না। ওটা নাকি লর্ড ক্লাইভের থুতু! 
ঠিক আছে, তবে এবার একটু বাংলা জ্ঞান পরীক্ষা করি। তুমি সোনালি জিপিএ পাওয়া ছেলে। দেশের রতœ বললেও কম বলা হবে। দৌহিত্র মানে কী বলো তো? ছেলে আবার অধোবদন, শব্দটি জীবনে সে এই প্রথম শুনেছে বলে মনে হলো। এবার তাহলে একটু বলবে, আমাদের ভিক্টরি ডে কবে? 
অমনি সে লাফিয়ে উঠে বলল, ২৬ মার্চ। শুনে আমার আক্কেল গুড়–ম! এ নাকি তার স্বদেশ প্রেমের নমুনা! এ ছেলের ছবি তো তাহলে দামি ফ্রেমে বাঁধাই করে দেয়ালে ঝুলাতে হয়! স্বর্ণরেণু বলে কথা। বিশ্বাস করুন, একটুও বাড়িয়ে বলছি না। আমি নিমিষে হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হলাম। তার মানে এই নয়, জিপিএ-৫ পাওয়া সবাই এমন। তবে ১ লাখের অর্ধেক যে তেমন কিছু না জেনেশুনেই রেজাল্ট বাগিয়েছে, একথা বোধ করি নির্দ্বিধায় বলা যায়। 
বাবা তার সোনার ছেলের পারফরম্যান্সে যারপরনাই হতাশ, সে কথা বলাই বাহুল্য। যার মতে সূর্যটা ব্যাঙের মতো লাফিয়ে ওঠে, মেয়ের ঘরের নাতি বা নাতনি যে দৌহিত্র হয় তা-ও জানে না, বিজয় দিবস আর স্বাধীনতা দিবস গুলিয়ে ফেলে, এহেন রতœ দিয়ে এ জাতি কী করিবে, বলুন! 
আরেকটি মেয়েকে শুধাই, ধরো তুমি হাঁটছ বা কোনো জরুরি কাজে যাচ্ছ, হঠাৎ এক বৃদ্ধ এসে বলল, মা, আমাকে রাস্তাটা একটু পার করে দেবে? তখন তুমি কী করবে? 
আমার কথা শুনে মেয়ে হেসেই বাঁচে না। বলে কী ভাইয়া! আমি যাব হেঁটে! আমার বাবার কতগুলো গাড়ি আছে জানেন আপনি? 
প্রশ্ন করে উল্টো আমি বুরবক বনে যাই। কিন্তু তার মানবিক বোধ সম্পর্কে জানাটা আমার জন্য জরুরি হয়ে উঠেছে। কারণ সে-ও সোনালি জিপিএ’র মালকিন। অধিকন্তু তার বাবার চারখানা গাড়ি আছে। বলি, ধরে না-ও সেদিন কোনো কারণে গাড়ি বের করা গেল না, কারণ তোমাদের গাড়ির কাগজপত্র ঠিক নেই। জাস্ট সাপোজÑ বৃদ্ধকে তুমি কী করবে? 
তেরছা হেসে প্রচুর মেক-আপ মাখা মেয়েটি বলল, কী আর করব? হাত দিয়ে বৃদ্ধকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজের কাজে বেরিয়ে যাব। আপনিই না বললেন, জরুরি কাজ! তাহলে কাজ রেখে উটকো ঝামেলায় কেন জড়াব বলুন তো! আ’ম নট সো স্টুপিড!
বিশ্বাস করুন, একটুও মিথ্যা বলছি না আমি। লেখালিখি করি; তাই কিছু বাতিকও আমার আছে। নিজের প্রেস্টিজের তেরোটা বাজিয়ে এমন কিছু ছেলেমেয়ের ইন্টারভিউ করেছিলাম। বুঝতে চেষ্টা করেছি, দেশ কোন দিকে যাচ্ছে! তাতে যা ফল পেয়েছি, সে আর কহতব্য নয়। আমি সত্যি হতাশ, আজকালকার অনেক ছেলেমেয়ে এমন কূপম-ূক আর অমানবিক হয়ে উঠেছে কেন! 
বৃক্ষ তোমার নাম কী ফলে পরিচয়। ‘ফলে ন পরিচিয় তে’ শুনে শুনে বড় হয়েছি আমরা। কিন্তু এ কোন ফল আমরা তৈরি করছি, বিষফল নয় তো! ভূরি ভূরি তথাকথিত ভালো ছেলে হচ্ছে, অতি উজ্জ্বল তাদের চোখের মণি; কিন্তু সেখানে দীপ্তি আছে কি! কেন যেন মনে হচ্ছে, ক্রমে দেশে একটি অতি স্বার্থপর, বার-চটকঅলা প্রজন্ম গড়ে উঠেছে। ফলে দেশে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ছে। বাল্যকালে শিখেছি, গুরুজনে করো নতি! অথচ শ্রদ্ধাবোধে সেই অবনমন নেই আমাদের ছেলেমেয়েদের মাঝে। এরা শুধু তুখোড় তক্কো বোঝে, জ্ঞান জাহির করে অথচ বড়দের প্রতি ভালোবাসা বা শ্রদ্ধা নেই। 
সারকথা এই, পড়ালেখাটা আসলে ঠিকঠাক হচ্ছে না। সামথিং ইজ ভেরি রঙ। রেজাল্ট-ওয়াইজ ভালো ছেলেমেয়ের সংখ্যা বাড়ছে; কিন্তু গুণবিচারে আশাবাদী হওয়ার মতো গল্প এখানে নেই। স্নাতকোত্তর বাড়ছে, চাকরির বাজারে প্রচ- চাপ তৈরি হচ্ছে; অথচ এরা কাজ করার মতো যোগ্য হিসেবে গড়ে উঠছে না। বোধের জায়গাটা বেশ নড়বড়ে, দক্ষতাও নেই তেমন। ফলে চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট নিয়েও অনেকে ভালো কাজ পায় না বা করে উঠতে পারে না। 
আমার পরিষ্কার উপলব্ধি, অধিক সংখ্যক শিক্ষিত বেকার নয়, বরং আমরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত, দক্ষ ও মানবিকবোধে উদ্দীপ্ত প্রোজ্জ্বল এক প্রজন্ম গড়তে চাই। যারা দেশকে ভালোবাসবে, বড়দের শ্রদ্ধা করবে, আর নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে শিক্ষিত মানুষের মর্যাদা রক্ষা করবে। গড়পড়তা জিপিএ-৫ পাওয়ার কোনো মানে নেই, এটা শুধু একটা সংখ্যা মাত্র, প্রকৃত জ্ঞান ও গুণের পরিমাপক নয়। হ

ষ অরুণ কুমার বিশ্বাস
অতিরিক্ত কমিশনার, বাংলাদেশ কাস্টম