আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১৫-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

ধূমপানের বিপদ ও তার প্রতিকার

হুসাইন আহমাদ
| প্রকৃতি ও পরিবেশ

বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে শুধু তামাকজনিত স্বাস্থ্য ক্ষতি থেকেই নয়, তামাক ব্যবহারজনিত সামাজিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকেও রক্ষা করতে তামাকের ওপর কর বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান বিশেষজ্ঞরা

ধূমপান সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি মহাবিপদ। তাই আজ বিশ্বজুড়ে ধূমপানের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। সারা বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ ধূমপানের শিকার হয়ে দিনের পর দিন সুন্দর স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা পুড়িয়ে ছাই করে ফেলছে। লাখ লাখ লোক ধূমপানজনিত ক্যান্সারসহ অন্যান্য রোগে মারা যাচ্ছে। কেউ কেউ বিভিন্ন ঘাতক রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অসহায় অবস্থায় অতি কষ্টে বেঁচে আছে।
ধূমপান জীবনীশক্তি, মস্তিষ্ক, ফুসফুস ও হৃৎপি-ের ক্ষতি করে; ধূমপান বিশ্বমানবের অসংখ্য ও অগণিত ক্ষতি করে থাকে। শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, আর্থিক এবং ইহলৌকিক ও পারলৌকিক তথা ধূমপান দ্বারা মানুষের সব রকম ক্ষতি হচ্ছে। ধূমপায়ী ক্ষতি করে নিজের, পরিবারের, সাথী-দর্শকের, সহযাত্রী-সহপাঠীর ও সঙ্গে অবস্থানকারী সব মানুষের। পাশের নিষ্পাপ শিশুর, গর্ভস্থ শিশুর ও ভ্রƒণের, বীর্যের ভেতরের শুক্রকীটের, ভবিষ্যৎ বংশধরের এবং দেশ ও জাতির। 
ধূমপানের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি : ধূমপানের প্রতি টানে মানুষের দেহে যতটুকু ধোঁয়া প্রবেশ করে তাতে রয়েছে কতগুলো বিষাক্ত পদার্থ। এগুলোর প্রভাবে দেহের প্রতিটি তন্ত্রের কার্যক্ষমতা ক্রমেই বিপন্ন হয়ে পড়তে থাকে, এর ফলে জন্ম নেয় হাজারো রোগ। মানবদেহে এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই যেখানে ধূমপান কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। ধূমপানের প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া হচ্ছেÑ
১. অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীরা তেমন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয় না এবং আয়ু বেশি পায় না।
২. ধূমপান পঙ্গু ও অসমর্থ করে দেয়।
৩. ধূমপানের ফলে মুখের ক্যান্সারসহ সব ধরনের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
৪. ধূমপানের অভ্যাস থেকে ব্রংকাইটিস, এম কাই সেমা, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ, স্ট্রোক, মস্তিষ্কের রক্তনালি ছিঁড়ে যাওয়া, বার্জাস ডিজিজ, গ্যাস্ট্রিক, আলসার ইত্যাদি রোগ হয়ে থাকে।
৫. হজমশক্তি বিনাশ, কিডনি, মূত্রাশয়, চোখ ও প্রজননতন্ত্রের গুরুতর গোলযোগ ও যৌন দুর্বলতার মূলে রয়েছে তামাকের বিষাক্ত ছোবল।
৬. গর্ভাবস্থায় ধূমপান স্বল্প ওজনের শিশু জন্মদান ও সদ্যজাত শিশুর মৃত্যুহার বাড়াতে সাহায্য করে থাকে।
৭. ধান ও কৃষিকাজের মতো পেশায় এবং ধোঁয়া নির্গত হয় এমন সব কারখানায় যারা কাজে নিয়োজিত, ধূমপান তাদের অকপেশনাল পালমোনারি দ্রুত ঘটাতে বা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
পরিবেশগত ক্ষতি : ১. বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া অফিস-আদালত, দোকান-পাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, রাস্তা-ঘাট এবং বাড়ি-ঘরের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষণ করে। এতে সার্বিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং রোগ বিস্তার ঘটে ব্যাপক হারে।
২. ধূমপানে যেমন ঘরের পরিবেশ নষ্ট হয়, তেমনি গর্ভের পরিবেশও নষ্ট হয়ে ক্ষতি করে গর্ভস্থ শিশুর।
নৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি : ধূমপানের সঙ্গে সামাজিক অবক্ষয়ের সংযোগ আছে। নেশা ও নৈতিকতার দ্বন্দ্ব আছে। একসঙ্গে দুটো চলতে পারে না। নেশার দাসত্ব এক অর্থে মানবিক পরাজয়।
১. বিড়ি-সিগারেট একটি নেশাজনিত বাড়তি খরচ। এ খরচ জোগাতে ব্যক্তির পদস্খলন আরম্ভ হয়।
২. প্রশাসনের বিভিন্ন পদে যারা ধূমপান করেন তাদের সিগারেটের মাধ্যমে প্রভাবিত করা খুব সহজ। আপ্যায়নের নামে সিগারেট অনেক সময় উৎকোচের (ঘুষের) পর্যায়ে পড়ে।
৩. শিক্ষক ও ডাক্তারদের জন্য ধূমপান একটি মারাত্মক অবক্ষয়। বয়স্ক ও গুরুজনরা ধূমপান করলে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হয়। তাদের প্রতি আর শ্রদ্ধাবোধ থাকে না, এতে এক পর্যায়ে পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা ধসে পড়ে।
৪. হুক্কা, সিসা যেমন মুখে মুখে ঘুরে, একইভাবে বিড়ি-সিগারেটও মুখে মুখে জ্বলে। ফলে একজনের মুখের জীবাণু অন্যজনের মধ্যে ছড়িয়ে সামাজিকভাবে রোগ বিস্তার ঘটায়।
৫. ধূমপানের ফলে অনেকের মুখেই বিশ্রী ও উৎকট দুর্গন্ধ হয়, যা কি-না সভা সমিতি, মসজিদ-মাদ্রাসা, অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্রই ঘৃণা ও বিরক্তির উদ্রেক করে। অনেক সময় দেখা যায়, শিশু ও নারীরা এ দুর্গন্ধ সহ্য করতে না পেরে ধূমপায়ীকে এড়িয়ে চলে, যার ফলে পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি হয়। ধূমপায়ীর গাড়ি বা ট্যাক্সিক্যাবে উঠে বিড়ি-সিগারেটের গন্ধে অনেকের মাথাব্যথাও শুরু হয়। অনেকে বমিও করে দিয়েছেÑ এমন হাজারো নজির আছে। ধূমপানকারীর ট্যাক্সিতে যাত্রীরা উঠতে চায় না, আর সে ইচ্ছা করেই সবার ঘৃণার পাত্র হচ্ছে।
৬. অনেক পরিবারের কর্তার বিড়ি-সিগারেট পান করার বদ অভ্যাস রয়েছে। এতে তার বিড়ি-সিগারেটের দুর্গন্ধে তার শিশু সন্তান ও নিজ স্ত্রীও তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও রোগগ্রস্ত হয়।
৭. বিড়ি-সিগারেট নেশার মতো, যারা এটা খায় তাদের ভাত-তরকারি না খেলেও চলে; কিন্তু বিড়ি-সিগারেট না খেলে তাদের চলে না। এটা তাদের নেশার মতো হয়ে গেছে। তাদের হাতে টাকা-পয়সা না থাকলেও তারা ঋণ করে এ নেশা মেটাবে। এ জন্য সমাজের মানুষে মানুষে মনোমালিন্য ও দূরত্ব বাড়ে।
৮. একজন ধূমপানকারী ব্যক্তি অশালীন, বদ অভ্যাসওয়ালা, হীন ব্যক্তিও বটে। সে মানুষকে সম্মান না দেখিয়ে বরং মানুষের অধিকারকে খর্ব করে, মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করে ও অবমূল্যায়ন করে মানুষের সামনে হঠাৎ বিড়ি-সিগারেট জ্বালিয়ে থাকে, তার মধ্যে সব সময় একটা ‘ডেমকেয়ার’ ভাব থাকে। এরা সত্যিকারভাবেই অহংকারী ও মানুষকে কষ্ট দিয়ে থাকে। অহংকার করা আর মানুষকে কষ্ট দেওয়া সব ধর্মেই নিষিদ্ধ। আর যারা অহংকারী এবং মানুষকে কষ্ট দেয় তাদের কেউই ভালোবাসে না।
বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে শুধু তামাকজনিত স্বাস্থ্য ক্ষতি থেকেই নয়, তামাক ব্যবহারজনিত সামাজিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকেও রক্ষা করতে তামাকের ওপর কর বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান বিশেষজ্ঞরা। (দৈনিক আমার দেশ ১৯/৫/২০১৪)। তারা আরও বলেন, প্রতিবছর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেলেও সে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না তামাকজাত পণ্যের দাম।
আর্থিক ক্ষতি : ধূমপানের ফলে কষ্টার্জিত অর্থের বিরাট অপচয় হয়। আল্লাহর দেওয়া আমানত আগুনে পুড়িয়ে শেষ করা হয়।
১. প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা এ ক্ষতিকর খাতে ব্যয় হচ্ছে।
২. ধূমপানের ফলে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসায় কত মানুষ সর্বহারা হচ্ছে।
৩. ধূমপান একটি অগ্নিকা-ের মতো, যে অগ্নিকা-ে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার সম্পদ ও আল্লাহর দেওয়া মানুষের অসংখ্য হার্ট ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের বাংলাদেশে প্রতিবছর বিড়ি-সিগারেটের পেছনে খরচ প্রায় ২ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। বার্ষিক এ খরচের টাকা দিয়ে ৪৮৫ কোটি ডিম বা ২৯ কোটি এক কেজি ওজনের মুরগি বা ২৯ লাখ গরু বা ১৪ লাখ টন চাল কেনা সম্ভব বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। (সূত্র : দৈনিক আমার দেশ, ১৯/৫/২০১৪)।
ইসলামের দৃষ্টিতে ধূমপান : ধূমপান মানব সমাজের অবর্ণনীয় ক্ষতি সাধন করে। তাই নিঃসন্দেহে ইসলামের দৃষ্টিতে তা হারাম। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের জন্য শুধু পবিত্র পানাহার হালাল করেছেন। আর তাদের ওপর অপবিত্র জিনিস হারাম ঘোষণা করেছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : ‘তারা আপনাকে জিজ্ঞাসা করবে, কোন জিনিস তাদের ওপর হালাল করা হয়েছে? আপনি বলুন, তোমাদের জন্য পবিত্র জিনিসগুলোই শুধু হালাল করা হয়েছে।’ (আল-মায়েদা : ৪)।
আল্লাহ তায়ালা সূরা আল-আরাফে তার নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘তিনি তাদের সৎকাজের আদেশ দেন আর অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করেন এবং তাদের জন্য সব ধরনের পবিত্র জিনিস হালাল করেন ও তাদের ওপর সব ধরনের অপবিত্র জিনিস হারাম করেন।’ (সূরা আল-আরাফ : ১৫৭)।
ধূমপান কখনোই পবিত্র জিনিসের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং তা মারাত্মক ক্ষতিকর ও অপবিত্র জিনিস। তাই ধূমপানের ব্যবসাও মাদকদ্রব্যের ব্যবসার মতো নাজায়েজ। অতএব, যারা ধূমপান করে ও ধূমপানের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের জন্য ওয়াজিব দ্রুত তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা এবং অতীত কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হওয়া ও ভবিষ্যতে এ কাজ না করার অঙ্গীকার করা। আর যে ব্যক্তি সত্যিকারভাবে তওবা করে আল্লাহ তায়ালা তার তওবা কবুল করেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনÑ
‘হে মোমিন বান্দারা! তোমরা প্রত্যেকে আল্লাহর কাছে তওবা কর, নিশ্চয়ই তোমরা সফলকাম হবে।’
ধূমপায়ী যেমন নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তেমনি সে ধীরে ধীরে নিজের জীবনীশক্তি নষ্ট করে আত্মহত্যার মতো অপরাধ করছে। অর্থের অপচয় বা অর্থ নষ্ট ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই অপচয়কারী শয়তানের ভাই।’ (ইসরা : ২৭)।
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (আল-আরাফ: ৩১)।
ধূমপান শুধু অপচয় নয়, সম্পূর্ণ ক্ষতিকর কাজে অর্থ নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখে দুর্গন্ধ হয় এমন সবজি বা কাঁচা পেঁয়াজ, রসুন খেয়ে মসজিদে আসতে নিষেধ করেছেন। 
এতে ফেরেশতা ও মানুষের কষ্ট হয়। হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি পেঁয়াজ, রসুন এবং পেঁয়াজের মতো গন্ধ হয় এমন কোনো সবজি খাবে, সে  যেন আমাদের মসজিদের ধারে-কাছেও না আসে, কেননা মানুষ যে খারাপ গন্ধ দ্বারা কষ্ট পায়, ফেরেশতারাও সে গন্ধ দ্বারা কষ্ট পায়।’ (মুসলিম : ১/৩৯৫)।
অন্য হাদিসে আছে, ‘যে কেউ আল্লাহ তায়ালা ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।’ (বোখারি : ৭/২৬)।
আরেক হাদিসে আছে, ‘ওই লোক প্রকৃত মুসলিম, যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদে আছে।’ (বোখারি : ১/১১)।
আর ধূমপান দ্বারা মুসলিমদের কষ্ট দেওয়া হয়, নিরপরাধ কোনো মুসলিমকে কষ্ট দেওয়া হারাম।