ছাত্রলীগের নবগঠিত কমিটি বাতিল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে হামলার প্রতিবাদে মঙ্গলবার ছাত্রলীগের একাংশের সংবাদ সম্মেলন ষ আলোকিত বাংলাদেশ
- পদবঞ্চিতদের ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম
- তোপের মুখে সভাপতি-সম্পাদক
- হামলার ঘটনায় তদন্ত কমিটি
- কাক্সিক্ষত পদ পাননি ২০০ নেতা
- উদ্বেগের কিছু নেই : হানিফ
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠনের দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়েছেন পদবঞ্চিত নেতারা। তা না করা হলে একযোগে পদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন তারা। মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ আলটিমেটাম দেওয়া হয়। সেখানে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে ছাত্রলীগের শীর্ষনেতারা জানিয়েছেন, কমিটি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নিজেই দেখবেন। সদ্য ঘোষিত কমিটিতে যদি কোনো ত্যাগী নেতা বাদ পড়ে যান, তাহলে সেটি বিবেচনা করা হবে। এদিকে সোমবার সন্ধ্যায় মধুর ক্যান্টিনে পদবঞ্চিতদের ওপর হামলার ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। তদন্ত কমিটিকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। পদবঞ্চিতদের বিক্ষোভ ও হামলা-মারধরের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশের কিছু নেই বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ। মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের এক যৌথ সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। এর আগে সেখানে হানিফের সভাপতিত্বে দলের একটি যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
জানা যায়, সম্মেলনের এক বছর পর সোমবার ছাত্রলীগের ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। ছাত্রলীগের সদ্য গঠিত পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে আপত্তি তুলতে গিয়ে পদ পাওয়া নেতাদের মারধরের শিকার হয়েছেন পদবঞ্চিতরা। সোমবার সন্ধ্যায় মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করতে এলে এ ঘটনা ঘটে। ফলে সংবাদ সম্মেলন প- হয়ে যায়। এ সময় পদবঞ্চিতরা দাবি করেন, সংগঠনের গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে ‘বিবাহিত ও অছাত্রদের’ কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। পরে মঙ্গলবার দুপুরে মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করেন পদবঞ্চিতরা। এ সময় গত কমিটির প্রচার সম্পাদক সাইফুদ্দিন বাবু বলেন, ‘যারা বিগত সময়ে সক্রিয়ভাবে ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের একটি বৃহৎ অংশকে বাদ কিংবা সঠিক পদে মূল্যায়ন করা হয়নি। যারা নিষ্ক্রিয়, সাবেক চাকরিজীবী, বিবাহিত, অছাত্র, গঠনতন্ত্রের অধিক বয়স্ক, বিভিন্ন মামলার আসামি, মাদকসেবী, মাদক ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন অপকর্মের দায়ে যারা ছাত্রলীগ থেকে আজীবন বহিষ্কার হয়েছিল, তাদেরই ছাত্রলীগে পদায়ন করা হয়েছে। এটা আমাদের ব্যথিত করেছে।’ তিনি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কমিটি পুনর্গঠনের দাবি জানান। এ সময় দাবি না মানলে অনশন ও গণপদত্যাগের ঘোষণা দেন নতুন কমিটির সাংস্কৃতিক বিষয়ক উপসম্পাদক নিপু তন্বী। তিনি শামসুন নাহার হলের সাবেক সভাপতি ও ডাকসুর সদস্য।
রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি বিএম লিপি আক্তার বলেন, ‘আমি রোকেয়া হলের সভাপতি এবং ডাকসুর কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় আমাকে ছাত্রলীগের উপসম্পাদক পদ দেওয়া হয়েছে। আমি ছাত্রলীগের সেক্রেটারিকে জিজ্ঞাসা করেছি, কোন ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে আপনি আমাকে ছাত্রলীগের উপসম্পাদক পদ দিয়েছেন। তিনি উত্তর দিয়েছেন, ডাকসুর গুরুত্বপূর্ণ পদে আছি বলে আমাকে এ পদ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাপারটা এমনÑ আপনি এবার এমপি নির্বাচন করেছেন, এবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচন করেন। আমার প্রশ্ন হলো, আপনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে থেকেও কেন ডাকসু নির্বাচন করলেন।’ এ সময় তিনি অভিযোগ করেন, ‘কমিটিতে যারা স্থান পেয়েছেন, তারা শোভন-রাব্বানী কমিটির ৮-১০ মাস রাজনীতি করেছেন, তাদের পেছনে পেছনে ঘুরেছেন। তাদের মেকানিজমে যারা, তাদেরই কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। আগের দুই কমিটির ত্যাগী কাউকে রাখা হয়নি।’ তদন্ত কমিটির ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘যারা মধুর ক্যান্টিনে মারধর করেছে, তাদেরই তদন্ত কমিটির সদস্য করা হয়েছে। এ তদন্ত কমিটি আমরা মানি না। ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সরাসরি নির্দেশেই হামলা চালানো হয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে নবগঠিত কমিটির উপগ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ফরিদা পারভিন, উপসাংস্কৃতিক সম্পাদক তিলোত্তমা শিকদার, উপপাঠাগার সম্পাদক জিয়াসমিন শান্তা, উপছাত্রবৃত্তি সম্পাদক শ্রাবণী শায়লা, উপ-আপ্যায়ন সম্পাদক খাজা খয়ের সুজন, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তানভীর সৈকত, আইন অনুষদ ছাত্রলীগ সভাপতি শরিফুল শুভ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
পদবঞ্চিত যারা : কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সোহাগ-জাকির কমিটির যারা সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন, তাদের মধ্যে অর্ধশতাধিক নেতা বর্তমান কমিটিতে পদ পাননি। তাদের মধ্যে রয়েছেনÑ দপ্তর সম্পাদক দেলওয়ার শাহজাদা, কর্মসূচি ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক রাকিব হোসেন, প্রচার সম্পাদক সাইফ বাবু, ক্রীড়া সম্পাদক চিন্ময় রায়, পাঠাগার সম্পাদক ইলিয়াস সানী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ক উপসম্পাদক রকিবুল হাসান, স্কুলছাত্র বিষয়ক সম্পাদক জয়নাল আবেদিন, গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক আনিসুল ইসলাম জুয়েল, আপ্যায়ন সম্পাদক রাশেদ মো. রাশিদুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নেতা সুস্ময় দেওয়ান, আহমেদ কাউছার, সৈয়দ আরাফাত, ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক তানভীর শাকিল প্রমুখ।
এছাড়া হল কমিটির সভাপতি-সম্পাদকরা বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় কমিটির পদে থাকলেও তাদের বর্তমান পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে রাখা হয়নি। এতে ক্ষুব্ধ তারা। এদের মধ্যে রয়েছেনÑ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সাধারণ সম্পাদক আল আমিন রহমান, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানী, মাস্টার দ্যা সূর্যসেন হল সভাপতি গোলাম সরওয়ার, কবি জসীমউদ্্দীন হলের সাধারণ সম্পাদক সাহেদ খান, বিজয় একাত্তর হল সভাপতি ফকির রাসেল আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক নয়ন হাওলাদার, শামসুন নাহার হল সভাপতি নিপু তন্বী ও সাধারণ সম্পাদক জেসমিন শান্তা, রোকেয়া হলের সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী দিশা, বাংলাদেশ কুয়েত-মৈত্রী হল সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ও সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী শায়লা, সুফিয়া কামাল হল সভাপতি ইফ্ফাত জাহান এশা ও সাধারণ সম্পাদক শারজিয়া শম্পা, শহিদুল্লাহ হল সভাপতি সাকিব হাসান ও সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসাইন রিফাত, ফজলুল হক হল সভাপতি শাহরিয়ার সিদ্দিকী সিসিম এবং একুশে হলের সাধারণ সম্পাদক এহসান পিয়াল।
পদবঞ্চিতরা জানান, যারা প্রায় ছয় থেকে সাত বছর ধরে রাজনীতি করে আসছেন, এদের অনেকেই বর্তমান কমিটিতে পদ পাননি। এদের সংখ্যা ২০০-এর মতো। এদের অনেকের সঙ্গে প্রতিবেদকের সরাসরি কথা হলে তারা অভিযোগ করেন, নতুন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে যারা এক বছর রাজনীতি করেছেন, তারাই কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পেয়েছেন। কিন্তু যারা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করে আসছেন, তারা পদ পাননি।
হাসপাতালে তোপের মুখে সভাপতি-সম্পাদক : সোমবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করতে গিয়ে নতুন পদপ্রাপ্তদের হামলায় যেসব পদবঞ্চিত আহত হন, রাতে তাদের হাসপাতালে দেখতে যান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বনী। এ সময় বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে পড়েন তারা দুইজন। এ সময় ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উভয়ই দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
তদন্ত কমিটি গঠন : হামলার ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে রয়েছেনÑ ছাত্রলীগের নতুন কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়, আইন বিষয়ক সম্পাদক ফুয়াদ হোসেন শাহাদাৎ এবং তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক পল্লব কুমার বর্মণ। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, সোমবার ইফতার-পরবর্তী সময়ে মধুর ক্যান্টিনে যে অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত ঘটনা হয়েছে, আমরা ছাত্রলীগ পরিবার তার তীব্র নিন্দা জানাই। সেই সঙ্গে ওই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির লক্ষ্যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। তদন্ত কমিটিকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরেজমিন অনুসন্ধান করে তথ্য-উপাত্তসহ প্রতিবেদন দপ্তর সেলে জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান ও সিনিয়র সহ-সভাপতি আল নাহিয়ান খান বলেন, ‘আমরা ঘটনার তদন্ত শুরু করেছি। তথ্য সংগ্রহ করছি। নির্দিষ্ট সময়েই প্রতিবেদন দেওয়া হবে।’
ছাত্রলীগের বক্তব্য : সদ্য কমিটিতে পদবঞ্চিতদের বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বলেন, ‘কমিটিতে যদি কোনো ত্যাগী নেতা বাদ পড়ে যান, তবে আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিষয়টি জানাব। তিনিই বিষয়টি দেখবেন।’ হামলার বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বনী বলেন, ‘হামলার ঘটনাটি অনাকাক্সিক্ষত। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মারামারি নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই Ñহানিফ : মঙ্গলবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, ছাত্রলীগের সম্মেলনের পর কমিটি গঠিত হয়েছে। ছাত্রলীগের হাজারো নেতাকর্মী আছেন; তারা সবাই যোগ্য। তারা সবাই পদ-পদবির প্রত্যাশা করেন। কিন্তু সবাইকে তো আর পদ-পদবি দেওয়া সম্ভব হয় না। স্বাভাবিকভাবেই যখন সবাই অন্তর্ভুক্ত হন না বা অনেকে পদ পান না, তখন তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি দেখা যেতে পারে; হওয়াটাই স্বাভাবিক। দেখা গেছে, অনেকে যে পদ পেয়েছেন, তাদের প্রত্যাশা ছিল আরও বড় পদ পাওয়ার। কাক্সিক্ষত সে পদ না পেয়ে অসন্তুষ্টি থাকতে পারে। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বলেন, যতটুকু জেনেছি, মধুর ক্যান্টিনে যে ঘটনা ঘটেছে, তা সামান্য ঘটনা। এটা নিয়ে আমার মনে হয় খুব উদ্বেগ প্রকাশ করার কিছু নেই। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বসেই এটা ঠিক করে ফেলতে পারেন এবং এর সমাধানের মাধ্যমে আবারও পুরোদমে ছাত্রলীগ কাজ করতে পারবে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, কৃষি বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ।