আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১৭-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

দুধেও ক্ষতিকর রাসায়নিক : রুখে দাঁড়াতে হবে

ড. মো. হুমায়ুন কবীর
| সম্পাদকীয়

দুধ একটি আদর্শ খাবার। কারণ দুধের মধ্যে সবগুলো পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকায় তা সব মানুষের উপাদেয় খাবার হিসেবে পরিগণিত। আমরা জানি, রোগীর পথ্য থেকে শুরু করে শিশু, নবজাতক, আবালবৃদ্ধবনিতা সবার প্রিয় খাবার হলো দুধ। কেক, রুটি, বিস্কুট, শিশুখাদ্যসহ যে কোনো ধরনের বেকারি আইটেম ও পিঠা, সেমাই, পায়েসসহ গৃহস্থালি মুখরোচক খাবার তৈরি করা হয় দুধ দিয়ে। অথচ এত গুরুত্বপূর্ণ একটি পানীয়ের সঙ্গে ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া খুবই ভয়ংকর একটি বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। এটি আরও বেশি ভাবিয়ে তুলেছে সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে ৯৬টি দুধের নমুনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য জেনে। সেখানে ৯৬টি নমুনার মধ্যে ৯৩টিতেই মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। 
খাদ্যে ভেজাল বিষয়টি এখন অনেকটা নিত্যনৈমিত্তিক। তা নিয়ে মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হয়। তবে সেটি নির্দিষ্ট কোনো সময়ে সীমাবদ্ধ থাকা সমীচীন নয়। সরকারের তরফ থেকে বিএসটিআই কিংবা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মতো সংস্থা সৃষ্টি করে দেওয়া রয়েছে। তারা সারাবছরই খাদ্যে ভেজাল বিষয়ে তৎপরতা চালানোর কথা। কিন্তু তাদের দেখা যায় বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে সীমিত আকারে ভ্রাম্যমাণ আদালত কিংবা অভিযান পরিচালনা করে কিছু সময়ের জন্য জেল-জরিমানা ও আলামত জব্দ ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণ করছে। রমজান মাস তার মধ্যে অন্যতম। রমজান মাস এলেই চোখে পড়ার মতো কিছু তৎপরতা লক্ষ করা যায়। 
আর এবারের রমজান মাসের আগে এবং রমজান মাসে খাদ্যে ভেজালের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। যেখানে ৫২টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর ভেজালের কারণে মহামান্য হাইকোর্ট এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার ওপর নাখোশ হয়ে বিভিন্ন গণমুখী নির্দেশনা দিয়েছেন। সেখানে দেশের অনেক নামিদামি ব্র্যান্ডের কোম্পানির পণ্যও রয়েছে। এগুলো পত্রিকান্তরে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। আশাকরি এতে ভোক্তাদের মধ্যে কিছুটা হলেও সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। অথচ আমরা যদি সামগ্রিকভাবে দেখি তাহলে কীসে ভেজাল নেই, সেটা বের করাই কঠিন হয়ে পড়বে। উদাহরণস্বরূপ ধান-চাল, আটা-ময়দা, তেল-চিনি, মশলা, মাছ-মাংস, শাকসবজি, ফলমূল, তরিতরকারি ইত্যাদি। 
এগুলো নিয়ে পত্রপত্রিকায় ও অন্যান্য গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়ে আসছে। কিন্তু দুধে এত ব্যাপকভাবে ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি সত্যিই আশঙ্কাজনকভাবে একটি আতঙ্কের বিষয়। উল্লেখিত কাঁচা তরল দুধে ৯৬টির মধ্যে ৯৩টি নমুনাতেই সিসা, অ্যান্টিবায়োটিক, অণুজীবসহ অসহনীয় মাত্রার আরও নানা ধরনের ভারি ও ক্ষতিকর ধাতু পাওয়া গেছে। প্যাকেটজাত দুধে ৩১টি নমুনার মধ্যে ১৮টিতেই ভেজাল পাওয়া গেছে। এছাড়া দুধ ও দইয়ে উচ্চমাত্রার বিভিন্ন রাসায়নিক পাওয়া গেছে। বিভিন্ন কোম্পানির দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যে ভেজাল এবং রাসায়নিক মেশানোর সঙ্গে জড়িতদের নাম চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। কারণ এর আগে ১১ ফেব্রুয়ারি অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে দুধে ভেজাল বিষয়ে একটি প্রতিবেদন চেয়েছিলেন কোর্ট। 
নমুনা পরীক্ষার পর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, গরুর খোলা তরল কাঁচা দুধে অণুজীবের সহনীয় মাত্রা ৪ থাকার কথা থাকলেও পাওয়া গেছে ৭ দশমিক ৬৬ পর্যন্ত। আলফাটক্সিনের সহনীয় মাত্রা শূন্য দশমিক ৫ হলেও পাওয়া গেছে শূন্য দশমিক ৯৯৬ পর্যন্ত। টেট্রাসাইক্লিনের মাত্রা ১০০ পর্যন্ত সহনীয় হলেও পাওয়া গেছে ৬৭১ দশমিক ১৩ পর্যন্ত, সিপ্রোফ্লক্সাসিনের মাত্রা ১০০ পর্যন্ত সহনীয় হলেও পাওয়া গেছে ১৪৮ দশমিক ৩৬ পর্যন্ত। কীটনাশকের মাত্রা ৫ সহনীয় হলেও পাওয়া গেছে ৯ দশমিক ৫০ থেকে ১৬ দশমিক ২০। প্যাকেটজাত দুধের ক্ষেত্রে টেট্রাসাইক্লিনের সহনীয় মাত্রা ১০০ হলেও দেশীয় প্যাকেটজাত দুধে পাওয়া গেছে ১৮৭ দশমিক ৫৮ পর্যন্ত। আমদানি করা প্যাকেটজাত দুধে এ উপাদানের মাত্রা ৭১৭ দশমিক ৮২ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। আর অলফাটক্সিনের সহনীয় মাত্রা শূন্য দশমিক ৫ হলেও পাওয়া গেছে ১ দশমিক ৯৩ পর্যন্ত। এ থেকেই ভয়াবহতা অনুমেয়।
দুধে ভেজাল তো আছেই। তার ওপর আবার শোনা যাচ্ছে পুরোপুরি ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার করে নতুন দুধ নাকি তৈরি করা হয়। সে ক্ষেত্রে দুধের ছানার পানির সঙ্গে আটা-ময়দার গুঁড়া, চক পাউডার, গুঁড়ো দুধ মিশ্রিত করে সঙ্গে আরও ফরমালিনসহ অন্যান্য রাসায়নিকদ্রব্য দিয়ে তৈরি করা হয় এ দুধ। এভাবে মিশ্রণটি তৈরি করা যেখানে ল্যাকটোমিটারেও নাকি তা ধরা পড়ে না। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, আমরা কী খেয়ে বেঁচে আছি! শুনেছি অসাধু গোয়ালরা দুধে পানি মেশায়, কিংবা দুধে কনডেন্সড মিল্ক মেশায় আবার ভেজাল দুধকে ঘন করার জন্য ভাগাড়ের ময়লা পানি মেশায়। এসব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে নতুন দুধ তৈরি করা। 
তবে সবকিছু যে কৃত্রিম উপায়ে হয় তাই নয়, কিছু পরিবেশগত এবং উদ্ভিদ-প্রাণিকুলের ফুড চেইনের মাধ্যমেও দুধে কিছু ভারি ধাতুর অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। কারণ গরু যে ঘাস খায় সেখানে ভেজাল, পানিতে ভেজাল, লবণে ভেজাল, বাজারজাত প্রস্তুতকৃত গোখাদ্যে ভেজাল, গরু মোটাতাজাকরণে ব্যবহৃত হয় ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক, মুরগিতে ভেজাল, ডিমে ভেজাল, মাছে ভেজাল, সব পণ্যে ভেজাল। কাজেই এসব ভেজালের ক্ষতিকর প্রভাব কোনো না কোনোভাবে গরুতে পড়ছে। সে সঙ্গে পড়ছে গোমাংস ও দুধের ওপরও। আর চূড়ান্তভাবে তো তা মানুষ নামক গিনিপিগের শরীরের ওপরই ভর করছে। আর তাই এখন পেটের পীড়াসহ ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের শরীরে। শোনা যায়, এখন নাকি হাসপাতালে ভর্তিকৃত শিশুদের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। বিষয়টি আসলেই শুধু ভয়ের নয়, আতঙ্কেরও। কাজেই সময় এসেছে রুখে দাঁড়ানোর। হাইকোর্ট থেকেও এসব বিষয়ে ছাড় না দেওয়ার জন্য রীতিমতো আদেশ জারি করা হয়েছে। তাই সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীল হওয়ার এখনই সময়। তা না হলে একটি জাতি পঙ্গু হয়ে যাবে। হ

ড. মো. হুমায়ুন কবীর
কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]