আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১৭-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

রমজানে দানের ফজিলত

কাজী সুলতানুল আরেফিন
| ইসলাম ও সমাজ

রমাজনে আল্লাহর কাছে যে কোনো ইবাদতের বিনিময়ে বেশি নেকি পাওয়া যায়। তেমনি রমজানে দানের ফজিলতও বেশি। তাই সবার উচিত অন্যান্য সময় থেকে রমজানে বেশি বেশি দান করা। এই দানের ক্ষেত্র হতে পারে দরিদ্র মিসকিন, মসজিদ-মক্তব এবং মানব কল্যাণে নিয়োজিত যে কোনো প্রতিষ্ঠানে দান করা যেতে পারে। রমজান মাসে মহান খোদাতায়ালা প্রতিটি নফল কাজের সওয়াব ৭০ গুণ বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ চাইলে এ দানের সওয়াব ৭০ হাজার গুণও বাড়িয়ে দিতে পারেন। 

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দানকারী আল্লাহর নিকটতম, বেহেশতের নিকটতম এবং মানুষের নিকটতম হয়ে থাকে। আর দূরে থাকে জাহান্নাম থেকে। অন্যদিকে কৃপণ ব্যক্তি দূরে অবস্থান করে আল্লাহ থেকে, বেহেশত থেকে এবং মানুষের কাছ থেকে। আর কাছাকাছি থাকে জাহান্নামের। অবশ্যই একজন জ্ঞানহীন দাতা একজন কৃপণ ইবাদতকারীর তুলনায় আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়।’ তিনি আরও বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা মানব সন্তানকে লক্ষ করে বলেন, ‘তুমি দান করো, তাহলে তোমার জন্য (আল্লাহর পক্ষ থেকে) দান করা হবে।’
আল্লাহর রাস্তায় দান করলে তা থেকে বরকত নিশ্চিত হয়। দানে কখনও টাকা বা ধনসম্পদ কমে না। বরং আল্লাহর রহমতে তা বহুগুণে বেড়ে যায়। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বলা আছেÑ ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ দান করে তার উদাহরণ হচ্ছে সেই বীজের মতো, যা থেকে সাতটি শিষ জন্মায়। আর প্রতিটি শিষে ১০০টি করে দানা থাকে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অতিরিক্ত দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা বাকারা : ২৬১)।
দানের বিনিময়ে আল্লাহ আমাদের কতটা পরিমাণে সওয়াব দেবেন, তা হাদিস পড়লে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। তবে দানের বিনিময় যাই হোক বা যে পরিমাণে হোক না কেন? আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের দিতে কার্পণ্য করবেন না বা করেন না! তাই সবার মুক্তহস্তে দান করা উচিত।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে কোনো কিছু ব্যয় করবে তাকে ৭০০ গুণ সওয়াব প্রদান করা হবে।’ (আহমাদ, সনদ সহিহ)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের হালাল কামাই থেকে (আল্লাহ হালাল কামাই ছাড়া দান কবুল করেন না) একটি খেজুর সদকা করে, আল্লাহ তা ডান হাতে কবুল করেন অতঃপর তা বৃদ্ধি করতে থাকেনÑ যেমন তোমরা ঘোড়ার বাচ্চাকে প্রতিপালন করে থাক, এমনকি তা একটি পাহাড় পরিমাণ হয়ে যায়।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
প্রচার করে দান করা আর গোপনে দান করা নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য দেখা যায়। তবে দান গোপন-প্রকাশ্যে যে কোনোভাবে করা যায়। প্রকাশ্য দানের উদ্দেশ্য যেন ঠিক থাকে। সব দানেই সওয়াব রয়েছে। 
মানুষকে দেখানোর জন্য বা নিজের প্রচারের জন্য কোনো দান আল্লহর দরবারে মূল্য নেই। তবে মানুষকে দানে উৎসাহিত করার জন্য প্রচার করে দান করা যেতে পারে।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন আল্লাহর ছায়া ব্যতীত কোনো ছায়া থাকবে না, তখন আল্লাহ তায়ালা সাত শ্রেণির লোককে তাঁর (আরশের) ছায়া দান করবেন। (তাদের মধ্যে একজন হলো) যে ব্যক্তি এত গোপনে সদকা বা দান করে যে, ডান হাত যা দান করে, বাম হাত তা টের পায় না।’ (বোখারি, মুসলিম, তিরমিজি, মুসনাদে আহমদ)।
তবে দান গোপন-প্রকাশ্যে যে কোনোভাবে করা যায়। প্রকাশ্য দানের উদ্দেশ্য যেন ঠিক থাকে। সব দানেই সওয়াব রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দানখয়রাত কর; তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি গোপনে ফকির-মিসকিনকে দান করে দাও; তবে এটা বেশি উত্তম। আর তিনি তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন।’ (সূরা বাকারা : ২৭১)। নবী করিম (সা.) বলেনÑ ‘কেয়ামত দিবসে সাত শ্রেণির মানুষ আরশের নিচে ছায়া লাভ করবে, তার মধ্যে একশ্রেণি হচ্ছেÑ ‘এক ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত কী দান করে বাম হাত জানতেই পারে না।’ (বোখারি ও মুসলিম)। 
হজরত বাহজ ইবনে হাকিম থেকে বর্ণিত, তিনি তার পিতা ও দাদার সূত্রে বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘গোপন দান বরকতময়, আল্লাহ তায়ালার ক্রোধ নিপতিত করে।’ (তাবরানি, তারগিব)।
ওই হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারলাম গোপনে দান করা হলে তার মর্যাদা কত বেশি। যেখানে বর্তমানে বেশিরভাগ দানেই দেখা যাচ্ছে আত্মপ্রচারই মূল উদ্দেশ্য!
তবে যে দান লোকদেখানোর জন্য করা হয় বা মানুষের প্রশংসা/বাহবা কুড়ানোর উদ্দেশ্যে করা হয়, তা সৎ দান নয়। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করে ও তা গোপন রাখে এবং গ্রহীতাকে এজন্য খোঁটা ও কষ্ট দেয় না তারা পুরস্কৃত হবে। তাদের কোনো ভয় ও দুঃখ-কষ্ট থাকবে না। (সূরা বাকারা : ২৬৩)। 
সূরা বাকারার শুরুতেই এরশাদ হয়েছেÑ এ (কোরআন) সেই কিতাব, এতে কোনো সন্দেহ নেই, এটি মুত্তাকিদের জন্য পথনির্দেশ। (মুত্তাকি তারাই) যারা গায়েবে ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে ও তাদের যে রিজিক দান করা হয়েছে, তা থেকে ব্যয় করে। (সূরা বাকারা : ২-৩)।
আবার অনেক মানুষ আছে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন; কিন্তু দানে তেমন আগ্রহী নন। শুধু ধন আর ধনের স্তূপ করা এদের নেশায় পরিণত হয়েছে। বস্তুত এমন লোকদের আল্লাহ মোটেই পছন্দ করেন না। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, তাদের মধ্যে এমনও কিছু লোক আছে, যারা আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করেছিল, ‘যদি তিনি নিজ অনুগ্রহে আমাদের ধন্য করেন, তাহলে আমরা দান করব এবং সৎ হয়ে যাব। কিন্তু যখন আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের বিত্তশালী করে দিলেন, তখন তারা কার্পণ্য করতে লাগল এবং নিজেদের অঙ্গীকার থেকে এমনভাবে পিছুটান দিল যে, তার কোনো পরোয়াই তাদের রইল না। ফলে তারা আল্লাহর সঙ্গে এই যে অঙ্গীকার ভঙ্গ করল এবং এই যে মিথ্যা বলতে থাকল, এ কারণে আল্লাহ তাদের অন্তরে মোনাফেকি বদ্ধমূল করে দিলেন, তার দরবারে তাদের উপস্থিতির দিন পর্যন্ত তা তাদের পিছু ছাড়বে না।’ (সূরা তওবা : ৭৫-৭৭)।
ধনসম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তায়ালা। তিনি যাকে ইচ্ছা তা প্রদান করে থাকেন। আবার যার থেকে ইচ্ছা তা কেড়ে নেন। ঠিক সম্মানের মতো। সৎপন্থায় সম্পদ উপার্জন ও সৎপথে তা ব্যয় করা হলেই ওই সম্পদের হিসাব প্রদান করা সহজ হবে। 
সূরা জারিয়াতের ১৯নং আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই তোমাদের সম্পদে নিঃস্ব ও অসহায়দের অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ আমরা যা দান করি, কোরআনের দৃষ্টিতে তা দয়া নয়; তা অসহায়দের অধিকার বা হক্কুল ইবাদ। আপনি যখন দান করেন, তখন আপনি সৃষ্টির অধিকারকেই সম্মান করেন। তখন স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহ আপনাকে সম্মানিত করবেন।
আসুন, সবাই একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশে সৎ উপার্জন থেকে দান করি। যার উদ্দেশ্য যেন আত্মপ্রচার না হয়!