আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১৭-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

ফুলেই প্রস্ফুটিত অঞ্জুর জীবন

আলোকিত ডেস্ক
| সুসংবাদ প্রতিদিন

ফুলের ব্যবসা করে দারিদ্র্যকে জয় করেছেন অঞ্জু সরকার। এলাকার লোক যাকে ‘ফুল বৌদি’ নামেই চেনে। চলাচল করেন ব্যক্তিগত গাড়ি করে। অথচ মাত্র এক দশক আগেও রাস্তায় হেঁটে হেঁটে ফুল বিক্রি করেছেন তিনি। মানুষের কাছ থেকে বিরূপ মন্তব্যও শুনেছেন। কিন্তু অঞ্জু দমে যাননি। শ্রম, সততা ও একাগ্রতা দিয়ে জয় করেছেন দারিদ্র্য আর অভাবকে। কঠিন পথ তিনি পার হয়েছেন সাহসের সঙ্গে।

বিয়ে করে কৃষক স্বামীর ঘর করতে এসেছিলেন যশোরের কেশবপুর উপজেলার অঞ্জু। স্বামীর অর্থনৈতিক অবস্থা এতই করুণ ছিল যে, তিন বেলা ভালো করে খাওয়া জুটত না। জীবিকার তাগিদে স্বামীর সঙ্গে মাঠে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন অঞ্জু। কিন্তু মাঠে কাজ করে পাওয়া সামান্য টাকায় তার সংসারের দুঃখ দূর হলো না। এক পর্যায়ে বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে ঝিয়ের কাজ শুরু করেন তিনি। ধান কাটা, আখ কাটা হেন কাজ নেই যা তিনি করেননি। শেষে একদিন ক্ষুধা আর অভাবের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে স্বামী-সন্তান নিয়ে ভারতে চলে যান অঞ্জু। সেখানে একটি ফুলের খামারে শ্রমিক হিসেবে কাজ নেন। ফুল চাষ, চারা রোপণ, বিক্রি সব কিছুই অঞ্জু শিখে নেন সেই ফুলের খামার থেকে। এরপর অঞ্জু সিদ্ধান্ত নেন তিনি দেশে ফিরে ফুলের চাষ ও ফুলের ব্যবসা করবেন। সময়টা ২০০৫ সাল। ভারতের সেই ফুলের খামারের মালিকের কাছ থেকে কিছু ফুলের চারা নিয়ে চলে আসেন নিজ গ্রাম কেশবপুরে। বাড়ির উঠানেই রোপণ করেন সেই চারা। শুরু হয় তার ফুল চাষের কাজ। চিন্তা করেন ফুলের ব্যবসা করবেন। কিন্তু ব্যবসা করতে যে টাকা লাগবে তা অঞ্জু কোথায় পাবেন? সেই টাকা তো তার হাতে নেই। সে সময় প্রতিবেশীদের পরামর্শে অর্থের সংস্থান করতে ঢাকা আহ্্ছানিয়া মিশনের সহযোগিতা চান তিনি। কেশবপুরের মূলগ্রামে প্রতিষ্ঠিত আশ্রয় গণকেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন অঞ্জু। তিনি জানতে পারেন, গণকেন্দ্র থেকে বিভিন্ন লাগসই কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণ করে অনেক দরিদ্র নারী বিভিন্ন আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মকা-ের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছেন। বদলে গেছে তাদের জীবনের ধারা।

অঞ্জুর ফুল চাষের প্রতি আগ্রহ দেখে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় ঢাকা আহ্্ছানিয়া মিশন। তাকে প্রাথমিকভাবে ২৫ হাজার টাকা ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে মিশন। ঋণের টাকার সঙ্গে নিজের পারিবারিক কিছু সঞ্চয় এক করে নিজের সামান্য জমিতে ফুল চাষ শুরু করেন। স্বামী সন্তোষ সরকার ও দুই ছেলেকে নিয়ে অঞ্জু বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শুরু করেন রজনীগন্ধা, গাঁদা, বেলি, ডালিয়া ও জিপসি ফুলের চাষ। জমিতে উৎপাদিত ফুল প্রথমে হাতে হাতে বিক্রি করতেন তিনি। পরে কেশবপুর বাজারে নিয়ে এসে বিক্রি শুরু করেন। অঞ্জু কিন্তু এখানেই থেমে যাননি। ফুল চাষ এবং বিক্রিকে আরও কার্যকর করতে উদ্যোগ নেন। বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে গায়ে হলুদসহ বিয়ের অনুষ্ঠান সাজানোর কাজও শুরু করেন। সঠিকভাবে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে থাকেন। ঢাকা আহ্্ছানিয়া মিশনও প্রতিবছর অঞ্জু সরকারের ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে চলে। এভাবে প্রতিবছর অন্যের জমি লিজ নিয়ে ফুল চাষের পরিধি বিস্তার করতে থাকেন তিনি। অঞ্জু সরকারের আগ্রহ ও উদ্দীপনা দেখে কেশবপুর থানার তৎকালীন ওসি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। থানার সামনে পড়ে থাকা খালি জমিতে তাকে ফুল চাষের অনুমতি দেন। সেই জমি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অঞ্জুর কাছে লিজ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে কেশবপুর বাজারে একটি দোকান তৈরির অনুমতিও দেন থানার সেই কর্মকর্তা। আর এভাবেই কেশবপুর বাজারে একটি ফুলের শোরুম প্রতিষ্ঠা করেন অঞ্জু। নাম দেন ‘শুভেচ্ছা ফুল ঘর’। তিনি এখন শুধু ফুলের ব্যবসাই করেন না, এর পাশাপাশি গায়ে হলুদ, বিয়ের অনুষ্ঠান, বাসর ঘর, হালখাতা, ভিআইপি ও রাজনীতিবিদদের অনুষ্ঠান সাজানোর কাজও করছেন। কেশবপুর উপজেলাসহ পুরো যশোর জেলায় কোনো অনুষ্ঠান হলেই ডাক পড়ে এই ফুল বৌদির। ফুল দিয়ে এক একটা অনুষ্ঠান সাজাতে সম্মানি বাবদ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পান তিনি। আর নিজস্ব প্রাইভেট কার থাকায় বাড়তি সুবিধাও হয়েছে। যে কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান হলে বরযাত্রার গাড়ি এবং সেই গাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো অবস্থায় আরও দুটি ফুলের দোকান দিয়ে অঞ্জু তার ব্যবসা বাড়িয়েছেন।
অঞ্জু এখন দৈনিক ১৫ হাজার টাকার ফুল বিক্রি করেন। প্রতি বছর তার ফুল বিক্রি থেকে আয় হয় প্রায় ১৪ লাখ টাকা। সেই টাকা থেকে সব খরচ মিটিয়ে তার হাতে থেকে যাচ্ছে প্রায় ৬ লাখ টাকা। অঞ্জুর এই ফুল ব্যবসায় কর্মসংস্থান হয়েছে স্কুল-কলেজপড়–য়া অনেক গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীর। অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থী ও দরিদ্র নারী অঞ্জুর সঙ্গে কাজ করছেন। অঞ্জু ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও নিয়ে রেখেছেন। সারা দেশে তিনি ছড়িয়ে দিতে চান ফুলের ব্যবসা। পাশাপাশি এ ফুল রপ্তানি করতে চান। 
অঞ্জু ১০১৩ সালে পেয়েছেন জয়ীতা পুরস্কার। ফুল ব্যবসার পাশাপাশি নিজ এলাকার নারী সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন এ পুরস্কার। ২০১৪ সালে আয়োজিত নবম সিটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কার প্রতিযোগিতায় অঞ্জু শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছেন। কৃষি উদ্যোক্তা ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে জাতীয় পর্যায়ে সম্মান অর্জন করেন তিনি। ফুল চাষ অঞ্জুর জীবনকে করেছে ফুলের মতোই প্রস্ফুতি। অঞ্জু বলেন, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন বদলে দিয়েছে তার জীবন। সূত্র ডিএফইডি