পদ্মা সেতু ৫৩৭১ কোটি
পদ্মা রেল সেতু ৩৯৯৫ কোটি
মেট্রো রেল ৭২১৩ কোটি
রূপপুর পারমাণবিক ১৪৯৮০ কোটি
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ ৩০৫৬ কোটি
কর্ণফুলী টানেল ১৩৫০ কোটি
গেল সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে দেশের চলমান মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। এসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধনের পাশাপাশি মানুষের কর্মসংস্থান, আয় ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বহুগুণ বাড়বে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারের প্রথম বাজেটে বিশেষ নজর থাকছে এসব বড় প্রকল্প। যোগাযোগ ও বিদ্যুতের বড় পাঁচ প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করতে আসছে বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া ফার্স্ট ট্র্যাকভুক্ত অন্যান্য প্রকল্পসহ বড় ১০ প্রকল্পে থাকছে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। মেগা এসব প্রকল্পে গুরুত্ব দিয়েই জাতীয় বাজেটের উন্নয়ন ব্যয় খাত বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) চূড়ান্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলেন, চলমান মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নই নতুন সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে থাকছে। তাই তো আসছে উন্নয়ন বাজেটের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ বরাদ্দ থাকছে অগ্রাধিকারের ১০ প্রকল্পে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাস্তবে রূপ পাওয়া এ ১০ প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটাই বদলে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এজন্য দ্রুত বড় প্রকল্পগুলোর উন্নয়ন দৃশ্যমান করতেই বাড়তি বরাদ্দও রাখা হচ্ছে। জানা গেছে, সরকারের বৃহৎ ও অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো ‘ফার্স্ট ট্র্যাক’ নামে নামকরণ করা হয়েছে। ফার্স্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পগুলো হচ্ছেÑ পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রো রেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প। এর মধ্যে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ শেষ। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পে এখনও অর্থ বরাদ্দ পায়নি। বাকিগুলো চলমান রয়েছে। মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে পুরোদমে চলছে পদ্মার দুই সেতু ও মেট্রো রেলের কাজ।
রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র : ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে সরকারের কাছে। তাই আসছে উন্নয়ন বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরদ্দ পাচ্ছে প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকার এ প্রকল্পে। ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ’ প্রকল্পটিতে চলতি অর্থবছরে ১১ হাজার ৩১৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও নতুন অর্থবছরের তা বাড়িয়ে ১৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এতে ক্রমপুঞ্জিভূত ব্যয় হয়েছে ১৬ হাজার ৬৬৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আসছে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ছে প্রায় ৩ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা।
পদ্মা সেতু : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের সড়ক যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন করতে সম্পূর্ণ দেশীয় টাকায় নেওয়া স্বপ্নের ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ’ প্রকল্পে চলতি বছর ২ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। দ্রুত সেতুর কাজ এগিয়ে নিতে আগামী বছর প্রায় দ্বিগুণ অর্থপ্রবাহ বাড়িয়ে বরাদ্দ করা হচ্ছে ৫ হাজার ৩৭০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকার এ প্রকল্পে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট খরচ হয়েছে ১৭ হাজার ৯০৩ কোটি ৩ লাখ টাকা। এরই মধ্যে সেতুর প্রায় ২ কিলোমিটার অংশ দৃশ্যমান হয়েছে।
পদ্মা রেল : নির্মিতব্য পদ্মার সড়ক সেতুতে রেললাইন স্থাপনের কাজ দ্রুত শেষ করতে ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে’ বরাদ্দও বাড়ছে আগামী অর্থবছরে। এ বছর প্রকল্পটিতে ৩ হাজার ২৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও আসছে বছরের জন্য তা বাড়িয়ে ৩ হাজার ৯৯৫ কোটি ২০ লাখ টাকা করা হচ্ছে। ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকার এ প্রকল্পে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ব্যয় হয়েছে ৯ হাজার ২৩০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
মেট্রো রেল : রাজধানীর যানজট নিরসনে নেওয়া দেশের প্রথম মেট্রো রেলের কাজ চলছে বেশ জোরেশোরেই। এজন্য ‘ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ বা এমআরটি-৬ নামে এ প্রকল্প ২০১৬ সালের জুনে উদ্বোধন করা হয়। ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৭ লাখ টাকা টাকার এ প্রকল্পে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৮৬০ কোটি ১৯ লাখ টাকা। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথম পর্যায়ে এয়ারপোর্ট থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১২ কিলোমিটারের কাজ শেষ করার কথা এব ছরের শেষে। তাই এ বছর ২ হাজার ৪৮৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা বরাদ্দ আগামী অর্থবছরে তিনগুণ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৭ হাজার ২১২ কোটি ৬৩ লাখ টাকায়।
কর্ণফুলী টানেল : চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং শহরের দুই অংশের নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ স্থাপনে দেশের প্রথম ট্যানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় কর্ণফুলীর তলদেশে। এজন্য গৃহীত ‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুলেন সড়ক টানেল নির্মাণ’ শীর্ষক প্রায় ৯ হাজার ৯৮০ কোটি ৪১ লাখ টাকার এ প্রকল্পে চলতি বছর বরাদ্দ রয়েছে ২ হাজার ১৭৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পটিতে মোট ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৪৩৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এ অবস্থায় আগামী অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ থাকছে ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। আগামী বছরের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র : দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নেওয়া কয়লাভিক্তিক ‘মাতারবাড়ী ২*৬০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট’ এ ব্যয় হচ্ছে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে এ বছর বরাদ্দ রয়েছে ২ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ক্রমপুঞ্জিভূত ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৬৯৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। আগামী বছর বরাদ্দ বাড়িয়ে ৩ হাজার ৫৬ কোটি টাকা করা হচ্ছে।
পায়রা বন্দর : বহির্বিশ্বের সঙ্গে এ দেশের সমুদ্রপথের বাণিজ্য আরও বাড়াতে পায়রায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে দুটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বা সুবিধাদির উন্নয়ন প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এতে চলতি এডিপিতে বরাদ্দ রয়েছে ৫৫২ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৬১০ কোটি টাকা খরচ হওয়া এ প্রকল্পে আগামী বছরের জন্য থাকছে ৫০০ কোটি টাকা। অপর দিকে গেল বছরের শেষের দিকে নেওয়া ‘পায়রা বন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ’ শীর্ষক ৩ হাজার ৯৮২ কোটি ১০ লাখ টাকার প্রকল্পে গেল সংশোধিত এডিপিতে প্রথম বারের মতো ১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়, যা আগামী বছর বাড়িয়ে ২১৩ কোটি টাকা করা হচ্ছে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে : ঢাকার উত্তরে যানজট নিরসনে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক এ প্রকল্পের মধ্যে এটি আরেকটি। জি-টু-জি ভিত্তিতে ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ হবে। এতে ব্যয় হবে ১৬ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। নির্মাণকাজ শেষ হলে প্রায় ৩০ জেলার সড়ক যোগাযোগ আরও সহজ হবে। চলতি অর্থবছরে প্রকল্পটিতে ৩০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা রয়েছে। আগামী অর্থবছরে ৪০০ কোটি বাড়িয়ে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৭০৫ কোটি টাকা।
বঙ্গবন্ধু রেল সেতু : যমুনা নদীর ওপর বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর রেলপথে ওজন সীমাবদ্ধতার কারণে ভারী পণ্যবাহী ট্রেন চলতে পারে না। তাই বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরালে আরেকটি রেলসেতুর জন্য ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতু নিমার্ণ’ শীর্ষক ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকার প্রকল্পে চলতি বছর বরাদ্দ ছিল ৪৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ১৮৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয় হওয়া প্রকল্পটির বরাদ্দ আগামী বছর বাড়িয়ে ২ হাজার ২২৫ কোটি টাকা করা হচ্ছে।