আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১৭-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

ম্লান কৃষকের মুখ

সাখাওয়াত হোসেন
| প্রথম পাতা

- দাম নিয়ে হাহাকার
- উঠছে না উৎপাদন খরচ

যিনি ভোগ্যপণ্য তৈরি করেন তিনি যেমন উৎপাদক, যিনি জমিতে ফসল ফলান তিনিও উৎপাদক। তবে দুই উৎপাদকের পণ্যের দাম নির্ধারণে পার্থক্য রয়েছে। উৎপাদিত ভোগ্যপণ্যের গায়ে দাম যুক্ত থাকে, ভোক্তা ওই দামে পণ্যটি ক্রয় করেন। আর কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের গায়ে কোনো দাম থাকে না। বছরে উৎপাদনের পরিমাণ আর চাহিদার ওপর ভর করে চলে বেচাকেনা। এতে অনেক ক্ষেত্রেই কৃষক লোকসানের মুখে পড়েন। ফাঁকে সুবিধা নেন কৃষক আর ভোক্তার মাঝে থাকা ফড়িয়ারা। চলতি বোরো মৌসুমেও কৃষকের মধ্যে যে উৎসবমুখরতা ছিল, তা কেড়ে নিয়েছে ধানের বর্তমান বাজার দর। ধানের দাম নিয়ে এরই মধ্যে কৃষকের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়েছে। মøান হয়ে গেছে তাদের মুখের হাসি। 

রংপুরের পীরগঞ্জের উপজেলার বড়দরগাহ ইউনিয়নের ডাসাড়পাড়া গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম। শ্রমিক সংকটে এখন পর্যন্ত ১ বিঘা জমির ধান ঘরে তুলেছেন। ধান উৎপাদনের আয়-ব্যয়ের একটি হিসাব আছে তার কাছে। বর্তমানে ১ বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনে সিরাজুল যে খরচ করছেন, তা তো উঠেইনি বরং লোকসান হয়েছে ৮ হাজার ৬২২ টাকা। সিরাজুল তার হিসাব দেখিয়ে বলেন, ধান উৎপাদনের জন্য ১ বিঘা জমিতে প্রথম ৩ হাজার টাকায় গোবর ছিটিয়েছেন। পরে প্রতি কাঠা (১ বিঘা = ২০ কাটা) ২৫ টাকা দরে ৪ বার চাষ করেছেন এতে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার টাকা। বাজার থেকে ২ হাজার টাকার চারা ক্রয় করে রোপণ করতে মজুরকে দিয়েছেন ১ হাজার ৮০০ টাকা। জমিতে ধান রোপণ করতে ব্যয় করেন ৮ হাজার ৮০০ টাকা। এ জমিতে ৩ দফায় সার প্রয়োগ করেছেন। ধান রোপণের আগে প্রতি কেজি ৩০ টাকা দরে ২০ কেজি ডিএবি’র মূল্য ৬০০ টাকা, ৩৫ টাকা কেজি দরে ১০ কেজি টিএসপি’র মূল্য ৩০০ টাকা, ১৭ টাকা কেজি দরে ২০ কেজি পটাশের মূল্য ৩৪০ টাকা এবং ৩০ টাকা কেজি ধরে ১০ কেজি জিপের মূল্য ৩০০ টাকা খরচ করেছেন। পরবর্তীতে দুই দফায় ১৭ টাকা কেজি দরে ৪০ কেজি ইউরিয়া সারের মূল্য ৬৮০ টাকা, ১৭  টাকা কেজি দরে ১০ কেজি পটাশের মূল্য ১৭০ টাকা, ৩০ টাকা কেজি দরে ৫ কেজি জিপের মূল্য ১৫০ টাকা, ১০৫ টাকা কেজি দরে ২ কেজি মিউটিভের মূল্য ২১০ টাকা ও ১১০ টাকা কেজি দরে ২ কেজি ম্যাগনেশিয়াম ব্যবহার করা হয়েছে। সর্বশেষ তৃতীয় দফায় ১৭ টাকা কেজি দরে ২০ কেজি ইউরিয়া মূল্য ৩৪০ টাকা ও ১৭ টাকা কেজি দরে ১০ কেজি পটাশ যার মূল্য ১৭০ টাকা খরচ করা হয়েছে। এ হিসাবের শেষ টানলে ১ বিঘা জমিতে তিন দফায় তিনি ৩ হাজার ৫৩০ টাকার সার ব্যবহার করেছেন। শুধু মাত্র জমি রোপণ ও সার প্রয়োগে তার খরচ হয় ৮ হাজার ৩৩০ টাকা। এছাড়া ওষুধে ব্যয় হয়েছে ৬০০ টাকা, আগাছা দমনে ১ হাজার টাকা, পানি সেচে ২ হাজার ৫০০ টাকা, মজুর দিয়ে ধান কর্তন করিয়েছেন ৬ হাজার টাকা ও ধান মাড়াইয়ে দিয়েছেন ৭০০ টাকা। 
কৃষক সিরাজুলের ১ বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনে মোট ব্যয় হয়েছে ২৩ হাজার ১৩০ টাকা। জমির সব খরচের পর ১ বিঘা জমিতে ধান পেয়েছেন ১ হাজার ২০৯ কেজি বা ৩০ মন ২২ কেজি। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি ধানের মূল্য সর্বোচ্চ ১২ টাকা। এ দরে তার জমিতে উৎপাদিত ধানের বাজার মূল্য ১৪ হাজার ৫০৮ টাকা। খরচ ও উৎপাদিত ধানের মূল্য বাদ দিলে দেখা যায়, সিরাজুল ১ বিঘা জমিতে ধান উৎপাদন করে লোকসান করেন ৮ হাজার ৬২২ টাকা। রংপুরের মতো ধানের মূল্য নিয়ে কৃষকের এমন হতাশা ময়মনসিংহ, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, নওগাঁ জেলায়ও।
ধানের দামের বিষয়ে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অশোক কুমার রায় মুঠোফোনে আলোকিত বাংলাদেশকে জানান, সারা দেশের মতো তারাগঞ্জ উপজেলায়ও একই অবস্থা। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সরকারিভাবে ধান ক্রয় করা শুরু হবে। বর্তমানে খোলাবাজারে যে বাজার দর চলছে, তাতে যারা নিজস্ব জমিতে বোরো চাষ করেছেন, তাদের ততটা লোকসান হবে না। ক্ষতিগ্রস্ত বেশি হচ্ছেন অন্যের জমি বর্গা ও লিজ নিয়ে বোরো ধান চাষ করা কৃষকরা। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, বর্তমানে কৃষকের ধান বিক্রি করতে হচ্ছে প্রায় ১৪ টাকা কেজি দরে। তবে সরকারি ধান ক্রয় শুরু হলে তা কেনা হবে ২৬ টাকা কেজি দরে। তখন কৃষক অবশ্যই লাভবান হবেন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদন হওয়া জেলা ময়মনসিংহের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, সেখানেও কৃষকের হতাশা। ধানের মূল্য নিয়ে কৃষকের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ ও হতাশা। হাটে ধান নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন কৃষক। ময়মনসিংহ সদর উপজেলার কোকিল গ্রামের সাইফুল ইসলাম জানান, এ বছর তিনি ১০ কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছেন। ৫ কাঠা জমিতে ২৮ জাতের ধান চাষ করেছেন। এতে কাঠাপ্রতি ফলন হয়েছে ৩ মণ করে। বিক্রি করেছেন ৭০০ টাকা দরে। বাকি ৫ কাঠায় হাইব্রিড কাঠাপ্রতি ৪ মণ ফলন হয়েছে, যা বিক্রি করেন ৫০০ টাকা মণ দরে। কাঠাপ্রতি তার সর্বসাকুল্যে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৫০০ টাকা। ১০ কাঠা জমিতে খরচ ২৫ হাজার টাকা। ধান বিক্রি করেছেন ২০ হাজার ৫০০ টাকার। কাঠাপ্রতি (৬.৫ শতাংশ) লোকশান গুণতে হচ্ছে ৪ হাজার ৫০০ টাকা। তিনি বলেন, সরকার ধানের যে সংগ্রহমূল্য ঘোষণা করেছে, বাজারে তার প্রায় অর্ধেক দামে ধান বিক্রি হচ্ছে। কৃষক খোরশেদ আলী ও সোরহাব আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কৃষক সবসময় সুবিধাবঞ্চিত হন আর মধ্যস্বত্বভোগীরা সবসময় সুবিধা নিয়ে থাকেন। বাজারে ধানের দাম না বাড়লেও চালের দাম তো কমেনি। সরকার নির্ধারিত মূল্যে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনা হলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পেয়ে ধান চাষে আগ্রহী হতেন। 
লালমনিরহাটের কৃষকরাও ধানের দামে হতাশ। জেলার আদিতমারী উপজেলার ভাদাই ইউনিয়নের আদিতমারী-উত্তর পাড়া গ্রামের কৃষক আমিনুল ইসলাম বাবুল। তিনি এবার বোরো মৌসুমে সাড়ে ৩ বিঘা জমিতে ধান করেছেন। এতে তার উৎপাদন খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। বিঘাপ্রতি সর্বোচ্চ ১৮ মণ ধান হয়েছে। বর্তমান বাজার দর ৪০০ টাকা মণ ধরলেও ৫৪ মণ ধানে আসবে ২১ হাজার ৬০০ টাকা। নগদে লোকসান ৮ হাজার ৪০০ টাকা। এমন পরিসংখ্যান দেখিয়ে বাবুল আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘কৃষক ধানেই মরবে’। একই এলাকার আরেক কৃষক ইয়াকুব আলীর ভাষ্যÑ বাজারে ধান নিলে বিক্রি হয় ৪০০ টাকা মণ। কিন্তু শ্রমিকের দিনে হাজিরা দিতে হয় ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা। এবারে দেড় মন ধানের দামের চেয়ে শ্রমিকের মজুরিই বেশি। কৃষক কী করবেন? পথে বসতে হবে। তিনি বলেন, গেলবার বাজার একটু ভালো ছিল। এবার উল্টো। বাবা-মাসহ পাঁচজনের সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ল তার।
এদিকে বৃহস্পতিবার থেকে দিনাজপুরে সরকারিভাবে বোরো ধান ক্রয়ের অভিযান শুরু হচ্ছে। কৃষকের কাছে জেলার ১৩টি উপজেলায় ধান কেনা হবে ৫ হাজার ৪৮ মেট্রিক টন। আর ২ হাজার ৪৭৯টি অটো ও হাসকিং মিলের কাছ থেকে চাল কেনা হবে ৯৩ হাজার ৮৩১ মেট্রিক টন। দিনাজপুরের জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. আশ্রাফুজ্জামান আলোকিত বাংলাদেশকে জানান, বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় দিনাজপুর সিএসডি গুদামে চলতি বোরো সংগ্রহ অভিযানের অংশ দরে সদর উপজেলার কৃষকের কাছে ধান কেনা কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল আলম। একজন কৃষকের কাছ থেকে সর্বনিম্ন তিন বস্তা ও সর্বোচ্চ ৩ মেট্রিক টন ধান কেনা হবে। তবে উপজেলা কমিটি ধান ক্রয়ের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। ২৫ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এ বছরের বোরো সংগ্রহ অভিযান চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। 
উত্তরের খাদ্যভা-ার নওগাঁ। এ জেলার উৎপাদিত ধান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চাহিদা পূরণ করে। চলতি বোরো মৌসুমে ধানের মূল্য কম পাওয়ায় কৃষকের মুখের হাসি মøান হয়ে গেছে। ধান এ অঞ্চলের কৃষকের জীবন। আবার ধানই যেন হয়ে উঠেছে কৃষকের মরণ। জেলায় ধানের উপযুক্ত দাম না থাকলেও চালের দাম আকাশচুম্বি। প্রতি কেজি জিরাশাইল ধানের চাল ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা কেজি দরে কেনাবেচা হচ্ছে। এতে প্রতি মণ চাল ১ হাজার ৩৫০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা পড়ছে। অথচ প্রতি মণ ধান কৃষককে ৬২০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬৫০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। উৎপাদক ও অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, ব্যবসায়ীক সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছেন এবারের কৃষক। 
নওগাঁ শহরের চাল বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমান বাজারে ধানের মূল্য কম হলেও আড়তদাররা ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৩৫০ টাকার কমে ৫০ কেজির এক বস্তা জিরাশাইল চাল বিক্রি করছেন না। ওই চাল আমরা খোলা বাজারে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি, যা প্রতি বস্তায় আমরা খুচরাভাবে ৫০ থেকে ১০০ টাকা লাভ করে থাকি। 
ধানে মøান কৃষকের হাসি : এদিকে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় কুড়িগ্রামে এবার বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এ কারণে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সন্তুষ্ট থাকলেও ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় হতাশ কৃষক। বর্তমানে যে দামে ধান বিক্রি হচ্ছে তাতে উৎপাদন খরচও উঠবে না বলে মনে করছে কৃষক।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানায়, এবার জেলার ৯ উপজেলায় ১ লাখ ১৪ হাজার ৪৮২ হেক্টর জমিতে (হাইব্রিড ও উফশীসহ) বোরো চাষ করা হয়েছে। তবে অর্জিত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৯১ হেক্টর ধান। এরই মধ্যে জমির প্রায় শতকরা ষাট ভাগ ধান কাটা শেষ। তবে বৃষ্টিপাত তেমন না থাকলে হয়তো সব জমির ধান সুষ্ঠুভাবে কর্তন করা সম্ভবপর হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। কৃষকও বলছেন, ফলন বিগত বছরগুলোর চেয়ে ভালো হলেও ধানের দাম পানির মতো। এতে তারা মারাত্মক কষ্টে পড়েছেন। ধানের দামের ব্যাপারে ন্যায্যমূল্য প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষিবিষয়ক এক কর্মকর্তা জানান, আমরা কৃষকদের ধান উৎপাদনে সহায়তা করি। ফলন ভালোমন্দ নিয়ে তাদের পরামর্শসহ সহায়তা দিই। কিন্তু দামের বিষয়ে দেখভাল করে খাদ্য বিভাগ। তাছাড়া এ ব্যাপারে আমাদের এখতিয়ারও নেই। উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের কৃষক ফরিদুল ইসলাম আজাদ জানান, এবার প্রায় এক একর জমিতে বোরো চাষ করেছি। আল্লাহর রহমতে ধানের ফলনও আশানুরূপ হয়েছে। কিন্তু ধান বিক্রি করতে গিয়ে দাম পাচ্ছি না। সরকার ধান কবে থেকে কিনবে তাও ঠিক নেই। নিজ জমির ধান বিক্রি করে যেমন লাভ নেই, বর্গাচাষিদের অবস্থা আরও করুণ। রাজারহাট উপজেলার ফরকেরহাট এলাকার কৃষক সরওয়ার্দি জানান, ‘হামরা কৃষকরা শুধুই বলির পাঁঠা। হামার কথা কাইয়ো ভাবে না। কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচে হেই কথা কাইয়ো মানে না’।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আলোকিত বাংলাদেশের রংপুরের ব্যুরো প্রধান আবদুর রহমান মিন্টু, নওগাঁর প্রতিবেদক হাফিজুর রহমান, ময়মনসিংহের প্রতিবেদক আদিলুজ্জামান আদিল, লালমনিহাটের প্রতিবেদক আরিফুর রশীদ, দিনাজপুরের প্রতিবেদক কামরুল হুদা হেলাল ও কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি একরামুল হক সম্রাট।