আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১৯-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

কৃষকের পাশে শিক্ষার্থীরা

ইরফান এইচ সায়েম
| প্রথম পাতা

শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি ও ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় সারাদেশে বোরো চাষিরা সংকটে পড়েছেন। অনেকেই শ্রমিক সংকটে খেত থেকে পাকা ধান কাটতে পারছেন না। কৃষকের অসহায় মুখ দেখে ধানের ন্যায্য মূল্যের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বেচ্ছাশ্রমে কৃষকের ধান কেটে দিয়ে সহায়তা করেছে তারা। কয়েকটি ছাত্র সংগঠন মানববন্ধন-বিক্ষোভ ও প্রতীকী কর্মসূচিও পালন করেছে। তারা বলছেন, যাদের উৎপাদিত পণ্য খেয়ে বেঁচে আছি তাদের সঠিক মূল্য আমরা দিতে পারছি না। সরকার বক্তব্য দিচ্ছে ধান বেশি হওয়ায় দাম কমে যাচ্ছে। অথচ চালের দাম ঠিকই বেশি। এটি কারণ নয়, সিন্ডিকেটের কারণে দাম কমে যাচ্ছে। চালকল মালিকরা পরিকল্পিতভাবে মূল্য কমিয়ে দিয়েছে। সরকারের এক্ষেত্রে কোনো নজরদারি নেই। সরকার এদিকে দ্রুত নজর না দিলে কৃষককে নিয়ে দাবি আদায়ে ছাত্র সমাজ রাজপথে নামবে।

চলতি বোরো মৌসুমে ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ১২ মে নিজ ধানক্ষেতে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পাইকড়া গ্রামের আবদুল মালেক নামের এক কৃষক। শুধু তিনি নন, দাম কম হওয়ায় ধানক্ষেতে আগুন ধরিয়ে নওগাঁ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা জেলাসহ দেশের বিভিন প্রান্তে কৃষক  প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা বলছেন, জমিতে ধান উৎপাদনে যে খরচ করা হয়েছে, তা তো উঠবেই না বরং লোকসান হবে। তাই তারা পাকা ধান কাটতে পারছেন না।

জানা গেছে, ধান কাটার শ্রমিকের বেশি পারিশ্রমিক চাওয়া ও ধানের দাম কম হওয়ায় আবদুল মালেক ক্ষোভে-কষ্টে নিজের ধান খেতে আগুন দেন। এ খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় ওঠে। পরে বুধবার আবদুল মালেকের খেতের ধান কেটে দিয়েছেন বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। ধান কাটতে দেওয়া মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজের শিক্ষার্থী আল আমিন বলেন, কৃষকের পাশে এসে কাজ করতে পেরে খুব ভালো লাগছে। কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। ১৪ মে ময়মনসিংহের ফুলপুরে ক্যান্সারে আক্রান্ত দরিদ্র বর্গাচাষি আবু বক্কর সিদ্দিকের ধান বিনামূল্যে কেটে দিয়ে সহায়তা করেছে হেলডস ওপেন স্কাউট গ্রুপের সদস্যরা। প্রথম দিনে ৮০ শতক জমির ধান কেটে দিয়েছেন তারা। আবু বক্কর সিদ্দিকের ৮০ শতাংশ জমিতে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু সেই ধান কাটার মতো শক্তি ও সামর্থ তার নেই। পরিবারে লোকজন নেই। শ্রমিক নিয়োগের টাকাও নেই। অথচ এ ধান কেটে তার নিজের চলতে হবে। আবার জমির মালিককেও ধান দিতে হবে। স্কাউট গ্রুপের দলনেতা তাসফিক হক নাফিও জানান, এবার ধান কাটার শ্রমিকের মজুরি বেশি হওয়ায় অনেক দরিদ্র চাষিই ধান কাটতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেন কয়েকজন দরিদ্র কৃষকের জমির ধান তারা স্বেচ্ছাশ্রমে কেটে দেবেন। তাদের তালিকায় এরকম আরও ১১ জন কৃষকের নাম আছে। তালিকার প্রথম নামটি ছিল কৃষক সিদ্দিকের। তারা সেই কৃষকের ধান কেটে দেন। ধান কাটার পর তা কৃষকের বাড়িতেও পৌঁছে দেন।
কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী টিলারগাঁও এলাকার আবদুল মতিন নামে এক কৃষকের খেতের ধান বিনামূল্যে কেটে দেন তারা। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাব্বির আহমেদ বলেন, এক মণ ধান উৎপাদন করতে কৃষকের খরচ হচ্ছে সাতশ’ থেকে আটশ টাকা আর বর্তমানে বাজারমূল্য হচ্ছে পাঁচশ’ থেকে ছয়শ’ টাকা। হঠাৎ করে ধানের মূল্য কমে যাওয়ায় কৃষক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
স্থানীয় একটি ক্রীড়া চক্রের উদ্যোগে একদল যুবক শুক্রবার শেরপুরের সদর উপজেলার চর মুছারিয়া ইউনিয়নে স্বেচ্ছাশ্রমে ধানকাটার কর্মসূচি গ্রহণ করে। এতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছিলেন। তাদের এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকও ছুটে আসেন ধান কাটতে। রাবি শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী জানান, শেরপুরে স্বেচ্ছাশ্রমে এই ধান কাটা কর্মসূচিটা হলো একটি দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয়। সারা দেশে এখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ বন্ধ আছেÑ এখন যদি শেরপুরের এই যুবক-শিক্ষার্থীদের মতো অসহায় কৃষকের ধান কেটে দেয় তাহলে কৃষক উপকৃত হবে। কারণ কৃষক বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। আমি আমার এক সাবেক ছাত্রের আহ্বানে স্বেচ্ছায় শেরপুর এসেছি তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ধান কাটতে।
টাকার অভাবে শ্রমিক দিয়ে ধান কাটতে পারছিলেন না ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মগর ইউনিয়নের ডহরপাড়া গ্রামের কৃষক বাচ্চু হাওলাদার। খবর পেয়ে শুক্রবার বরিশাল থেকে কলেজ শিক্ষার্থীরা গিয়ে হাজির হয় তার বাড়িতে। ওই তরুণরা বাচ্চু হাওলাদারের জমির ফসল কেটে দেয় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে।
বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের’ ব্যানারে আয়োজিত এক মানববন্ধনে ধানসহ সব কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, কৃষি খাতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি প্রদান ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনার দাবি জানানো হয়। একই দিনে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সদস্যরা দেশের ১৬টি স্থানে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। এর আগে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে সংগঠনটি। 
‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের’ যুগ্ম আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নূর বলেন, এই দেশের অর্থনীতি যে কৃষির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেই দেশের কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। গণমাধ্যমে প্রতিদিন খবর আসছে। কৃষকের পাশে ছাত্রসমাজ আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কৃষক এ দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তাদের ধানের ন্যায্যমূল্যের দাম যদি না দেওয়া হয়, তাহলে তারা কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। সেটি এই রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর হবে। কৃষকদের ধানের ন্যায্য দাম দেওয়ার জন্য একটি তদারকি সেল গঠন করার দাবি জানান তিনি। সরকার যদি কার্যকার কোনো পদক্ষেপ না নেয় তবে আমরা কৃষককে সম্পৃক্ত করে তাদের দাবিদাবা আদায়ে প্রয়োজনে আমরা কর্মসূচি পালন করব।
শুক্রবার বিকালে রাজধনীর শাহবাগস্থ জাতীয় জাদুঘরের সামনে ছাত্র ফেডারেশনের উদ্যোগে ধানকাটার মৌসুমেই হাটে হাটে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্য দামে ধান ক্রয় করার দাবিতে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এ কর্মসূচি থেকে আগামী তিন দিনের মধ্যে কৃষকের ভর্তুকির ব্যবস্থা না করলে ২০ মে শাহবাগে কৃষিমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ করার ঘোষণা দিয়েছেন। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জাহিদ সুজন বলেন, কৃষককে বাঁচাতে না পারলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। সুতরাং অবিলম্বে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকেই ধান ক্রয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। বিপর্যস্ত কৃষকের ধান কেটে দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য ছাত্র সমাজের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। সংগঠনটির সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, প্রতি মৌসুমে শুধু কৃষকের লোকসান হচ্ছে। এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কৃষিমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রী। তিনি তাদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, অবিলম্বে কৃষকের সমস্যা সমাধান না হলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি মেহেদী হাসান নোভেল বলেন, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এক হাজার টন চাল কিনবে। কিন্তু আমরা বলছি যে, আরও বেশি ক্রয় করুক। যেটা প্রয়োজন আর কৃষক যাতে উপকৃত হয়। কৃষকের ভর্তুকি যেমন সারসহ অন্য বিষয়গুলোর ব্যাপারেও যেন সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেয় সে ব্যাপারে সরকারকে আমরা বলেছি। তিনি আরও বলেন, আমরা দ্রুতই এই দাবি মানতে বলেছি। যদি সরকার দ্রুত দাবি বাস্তবায়ন না করে তবে আমরা দুই-একদিনের মধ্যেই কর্মসূচি দিব।