-খালেদার মুক্তি নিয়ে ফের অনিশ্চয়তায় বিএনপি
-চার মামলায় জামিন বাকি, মুক্তি নিয়ে তৃণমূলে হতাশা
-চিকিৎসা নিয়েও অসন্তোষ, পছন্দের হাসপাতালে সুচিকিৎসার দাবি
সরকারের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে সংসদে যোগ দেওয়ার বিনিময়ে প্যারোলে বা জামিনে খালেদা জিয়ার মুক্তির গুঞ্জন নিয়ে অনেকটা আশাবাদী মনোভাব দেখা দিয়েছিল বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে। কিন্তু পরবর্তীতে ওই আশা নিরাশায় পরিণত হয়েছে। দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তি নিয়ে এখন চরম অনিশ্চয়তায় রয়েছে বিএনপি। এতে সংশ্লিষ্ট মহলে চরম হতাশা ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
দলীয় সূত্র মতে, চারটি মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন বাকি রয়েছে। আর সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া এসব মামলায় জামিনের কোনো আশা দেখছেন না বিএনপির আইনজীবীরা। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আন্দোলনের কথা বলা হলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কর্মসূচি পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলো। খালেদার মুক্তি দাবিতে শনিবারও জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয়তাবাদী মহিলা দল মানববন্ধন এবং নয়াপল্টনে মিছিল করে ছাত্রদল ঢাকা মহানগর পশ্চিম শাখা।
এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বিএনপি। তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন দাবি করে অবিলম্বে তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে পছন্দের বিশেষায়িত হাসপাতালে সুচিকিৎসার দাবি জানিয়েছে দলটি। শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার এ দাবি জানান।
সূত্র মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপির এমপিরা শপথগ্রহণ ও সংসদে যোগ না দেওয়ার ঘোষণা দিলেও পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার মুক্তির শর্তে ওই অবস্থান থেকে সরে আসে দলটি। এ নিয়ে সরকার পক্ষের সঙ্গে সমঝোতারও গুঞ্জন শোনা যায়। তবে প্যারোলে না কী জামিনে মুক্তি হবেÑ তা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। যদিও বিএনপি বা সরকার পক্ষ থেকে সমঝোতার বিষয়টি নাকচ করে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে নাটকীয়ভাবে সিদ্ধান্ত বদল করে মির্জা ফখরুল বাদে বিএনপির পাঁচ এমপি সংসদে যোগ দেন। তবে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে কোনো সমঝোতার আলামত দেখতে পাচ্ছেন না নেতাকর্মীরা। এমনকি আইনগতভাবে জামিনে মুক্তির ব্যাপারেও আশাবাদী হতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। এতে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে বেশ হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও ‘গণতন্ত্র ও খালেদা জিয়া মুক্তি আইনজীবী আন্দোলনের’ কো-চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবেদ রাজা আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। যারা জামিনে মুক্তির চিন্তা করেন, তারা অলিক স্বপ্নে বাস করছেন। তার মুক্তির একমাত্র উপায় আন্দোলন। সেই আন্দোলনের জন্য আমাদের শক্তি-সামর্থ্যরে মধ্যে আইনজীবীদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছি।
‘আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার জামিন সম্ভব না। আন্দোলনের মাধ্যমেই তাকে মুক্ত করতে হবে’ বারবার এমন বক্তব্য দেওয়ার পরও আন্দোলন কর্মসূচিতে যাচ্ছেন না কেন?Ñ এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, বিএনপি একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। এ দলের পক্ষে আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই। আমরা কোনোভাবেই আইন লঙ্ঘন করতে পারি না। চেষ্টা করছি, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তাকে মুক্ত করতে। আপাতত প্যারোলে মুক্তির কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি। শনিবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার এসব কথা বলেন।
এ সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে কীভাবে কথা শোনাতে হয়, সে ব্যবস্থা করা হবে বলে হুঁশিয়ার করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মির্জা আব্বাস।
আন্দোলন না করে এভাবে সংবাদ সম্মেলন করে খালেদা জিয়ার মুক্তি জানালে ক্ষমতাসীন দল ব্যবস্থা নেবে কি নাÑ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা আব্বাস বলেন, আওয়ামী লীগকে কীভাবে কথা শোনাতে হয়, সে ব্যবস্থা আমরা একসময় করব। এত চিন্তা করে লাভ নেই।
আইনজীবীরা জানান, কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৮টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট এবং মানহানির দুইটি মামলায় জামিন নেওয়া বাকি রয়েছে। তবে মানহানির অভিযোগে করা দুইটি মামলা জামিনযোগ্য হওয়ায় মূলত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলে তিনি কারামুক্তি পেতে পারেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সূত্র মতে, ৩০ এপ্রিল জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজা বাতিল ও খালাস চেয়ে বেগম খালেদা জিয়ার আপিল আবেদন শুনানির জন্য গ্রহণ করে অর্থদ- স্থগিত ও সম্পত্তি জব্দের আদেশের ওপর স্থিতাবস্থার নির্দেশ দেন আদালত। তবে মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানি গ্রহণ করেননি হাইকোর্ট। জামিনের আবেদনটি নথিভুক্ত করে দুই মাসের মধ্যে মামলার নথি তলব করা হয়।
অন্যদিকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল আবেদন এবং একই সঙ্গে খালেদার জামিন আবেদন করা হয়েছে। এ আপিল আবেদন আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। এ মামলায় নিম্ন আদালত খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদ- দেন। এরপর হাইকোর্ট খালাস চেয়ে খালেদা জিয়ার আপিল খারিজ করেন এবং দুদকের আপিল গ্রহণ করে খালেদা জিয়াকে ১০ বছরের কারাদ- দেন। এ রায় বাতিল ও খালাস চেয়ে তিনি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল আবেদন করেন।
আর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে মন্তব্য করার পর দুইটি মানহানি মামলা করা হয়। এ মামলা দুইটি ঢাকা সিএমএম কোর্টে রয়েছে। এ মামলায় আদালত থেকে সংশ্লিষ্ট থানায় ওয়ারেন্ট দেওয়া হলেও এখনও তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। যেহেতু এ মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি, সেহেতু জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় জামিন নিয়ে বের হয়ে তিনি এ মামলায় জামিন নিতে পারবেন বলে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা জানান।
জামিন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, খালেদা জিয়ার জামিনে একমাত্র বাধা শেখ হাসিনা। এ ধরনের বাধা দেওয়া থেকে বিরত খাকার আহ্বান জানান তিনি।
পছন্দের হাসপাতালে সুচিকিৎসার দাবি : কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া হাসপাতালে পায়েস নয়, জাউ খাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার। শনিবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান।
জমির উদ্দিন সরকার বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি (বেগম জিয়া) আয়েশ করে পায়েস খাচ্ছেন। তিনি অসুস্থতার নামে নাটক করছেন। দেশের একজন বর্ষীয়ান ও জনপ্রিয় রাজনীতিবিদের অসুস্থতা নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী যে ধরনের বিদ্রুপ ও রসিকতা করেছেন, তা নজিরবিহীন। এ ধরনের দৃষ্টান্ত সভ্য দেশ ও সমাজে একেবারেই বিরল।
বিএনপির এ নেতা বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের মুখে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, এ ক্ষতের জন্য মুখে প্রচ- ব্যথার সৃষ্টি হয়েছে; যার কারণে তিনি স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া করতে পারছেন না, কোনো রকম জাউ খেয়ে জীবন ধারণ করছেন। অথচ সরকার প্রধান থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী ও নেতারা বেগম জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করে যাচ্ছেন, যা শুধু অমানবিকই নয়, নিষ্ঠুর মনুষ্যত্বহীন মনেরও বহিঃপ্রকাশ।
জমির উদ্দিন সরকার আরও বলেন, খালেদা জিয়ার নিউমোনিয়ার সম্ভাবনা বেশ প্রবল হয়ে উঠেছে। এছাড়া কারাগারে থাকার সময় সেখানকার পরিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর মাত্রার ভিটামিন ‘ডি’ ও ক্যালসিয়ামের শূন্যতা দেখা দিয়েছে; যা তার হাড়ের জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
তিনি বলেন, এমনিতেই অনেক আগে থেকেই তিনি (খালেদা জিয়া) বাম কাঁধ ও হাতের ব্যথায় ভুগতেন। এখন ওই ব্যথা ডান কাঁধ ও হাতে সম্প্রসারিত হয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তিনি এখন দুই হাতেই নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করছেন। সর্বশেষ তার স্বাস্থ্য পরীক্ষায় জানা গেছে, ইনসুলিন ব্যবহারের পরও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ তো হচ্ছেই না, বরং তা বিপজ্জনক মাত্রায় অবস্থান করছে। কারাগারের দূষণযুক্ত পরিবেশে তার স্বাস্থ্য, সুস্থতা ও জীবন সবই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বেগম জিয়া এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিষ্ঠুর রসিকতায় একটি স্বৈরাচারী সরকারের ভয়াবহ রুপটিই ফুটে ওঠে বলে মন্তব্য করেন জমির উদ্দিন সরকার।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে নিজ দলের উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখার একপর্যায়ে বলেছিলেন যে, বেগম জিয়া কোনো দিনই কারাগার থেকে বের হবেন না। তিনি দেশে এসে সেটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বাস্তবায়ন করছেন। এরই মধ্যে কেরানীগঞ্জে আদালত স্থানান্তরের এসআরও জারি করা হয়েছে। এ নির্দেশ কিসের জন্য এবং কার জন্য করা হচ্ছে, তা জনগণের বুঝতে বাকি নেই।
জমির উদ্দিন সরকার বলেন, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা যাতে চরম অবনতি না ঘটে, সেজন্য তাকে অবশ্যই বিশেষায়িত হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করানো অত্যন্ত জরুরি। তাই আমরা অবিলম্বে খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি এবং তার পছন্দনীয় হাসপাতালে সুচিকিৎসার জোর দাবি জানাচ্ছি।