হজরত শাহজালাল (রহ.) সম্পর্কে লেখা আছে, তিনি জীবনের শেষ ৪০ বছর অনবরত রোজা রাখতেন এবং প্রতি ১০ দিন অন্তর নিজের গাভীর সামান্য দুধ পান করতেন। তিনি সারা রাত দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তেন। স্থানীয় অধিবাসীরা তার কাছেই ইসলাম কবুল করে। তিনি অত্যন্ত কৃশ ও লম্বা ছিলেন। মুখে অল্প গোঁফ-দাড়ি ছিল। ওফাতের আগের দিন তিনি মুরিদদের ডেকে বলেন, ‘আল্লাহর হুকুমে কাল আমি তোমাদের ছেড়ে চলে যাব। আল্লাহর উপর ঈমান রেখো। তিনি-ই তোমাদের রক্ষা করবেন।’
বিশ্ববিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা ফখরুদ্দীন মুবারক শাসনমলে ১৩৩৮-১৩৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে আসেন। ইবনে বতুতা বাংলাদেশে আগমনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সিলেটে গিয়ে সেখানে অবস্থানরত কামেল দরবেশ হজরত শাহজালাল (রহ.) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। মরক্কোবাসী এ বিখ্যাত পর্যটক সিলেটে এসে হজরত শাহজালাল (রহ.) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। সিলেটে আগমনের প্রাক্কালে এবং এখানে অবস্থানকালে তিনি হজরত শাহজালাল (রহ.) এর যে অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় পান তা তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে লিপিবদ্ধ করেন।
সাতগাঁও থেকে রওয়ানা হয়ে একনাগাড়ে এক মাস চলার পর আমি কামরুপের পার্বত্য অঞ্চলে পৌঁছলাম। এই পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে ভ্রমণের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর প্রিয় শেখ জালাল উদ্দিন তাব্রিজির সঙ্গে মোলাকাত করা। এই শেখ একজন শ্রেষ্ঠ দরবেশ ছিলেন এবং অনেক অলৌকিক ব্যাপারে তার সুখ্যাতি ছিল। শেখের সঙ্গে দেখা করার অভিপ্রায়ে আমি যখন যাচ্ছিলাম তখন তার চারজন সহচর তার অবস্থান থেকে দুই দিনের পথ এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে মিলিত হন। তাদের মুখ থেকে শুনলাম দরবেশ তাদের বলেছেন, ‘মুরদেশীয় একজন পর্যটক আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। তোমরা যাও, তাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে আস।’
‘আমি এদের সঙ্গে দরবেশকে দেখতে রওয়ানা হলাম। একটি গুহার মধ্যে তার হুজরা। তার খানকার কাছে কোনো বাড়িঘর ছিল না। কিন্তু চারদিক থেকে বহু হিন্দু, মুসলমান খাদ্যদ্রব্যগুলো নিয়াজ স্বরূপ মনে করে দরবেশকে দেখতে আসতেন। খানকার ফকিরদের ও অতিথিদের এতেই স্বচ্ছন্দে চলে যেত। দরবেশের সম্পত্তির মধ্যে শুধু ছিল একটি গাভী। এ সময় তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ।’
আমি যখন দরবেশের সামনে হাজির হলাম তখন আমাকে দেখে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি আমার সম্পর্কে এবং আমার পরিভ্রমণ সম্পর্কে নানা কথা জিজ্ঞেস করলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি আরব থেকে এসেছেন?’ আমি বললাম ‘না’; তখন তিনি তার সহচরদের আদেশ দিলেন, ‘যাও তোমরা তাকে যথারীতি সম্মান প্রদর্শন কর।’ এরপর তারা আমাকে গুহার বাইরে তার খানকায় নিয়ে গেলেন এবং তিন দিন পর্যন্ত অতিথি সেবা করলেন।
তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত ‘আজাইবুল আছফারে’ ইবনে বতুতা মহাপুরুষ হজরত শাহজালাল (রহ.) এর আধ্যাত্মিক শক্তির বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে আরেকটি অবিস্মরণীয় ঘটনার উল্লেখ করেছেন। ইবনে বতুতার নিজের ভাষায়, ‘শেখের সঙ্গে প্রথম দিনের সাক্ষাতের সময় আমি তার পরিধানে ছাগলের চামড়ার তৈরি একটি সুন্দর লাল জোব্বা দেখেছিলাম এবং মনে মনে ভাবছিলাম শেখ যদি এই জোব্বাটি আমাকে দিতেন তাহলে আমি খুব খুশি হতাম। তাজ্জবের ব্যাপার, বিদায়ের দিন শেখ সত্যিই নিজে গা থেকে জোব্বাটি খুলে আমাকে পরিয়ে দিলেন। বাইরে আসার পর তার সঙ্গীরা আমাকে জানালেন শেখের কখনোই জোব্বা পরার অভ্যাস ছিল না। আমার আসার দিনই নাকি তিনি জোব্বাটি গায়ে চাপিয়ে সহচরদের বলেছিলেন যে, এই জোব্বাটি আমি চাইব এবং তিনি তা আমাকে দিবেন। কিন্তু পোশাকটি প্রকৃতপক্ষে শেখের দোস্ত চীন দেশে ইসলাম প্রচারক বুরহান উদ্দিন সাগরজীর জন্য তৈরি করা হয়েছে এবং যথাসময়ে এটি তার হাতেই পৌঁছবে। চীনে পৌঁছামাত্র এক বিধর্মী রাজা পোশাকটি ছিনিয়ে নিয়ে সাগরজীকে উপহার দেবে। আমি বললাম, ‘আমি যখন দরবেশের আশীর্বাদ এই জোব্বা পেয়েছি এটা পরে আমি কোনো বিধর্মী রাজার সামনে যাব না।’ এরপর আমি শেখের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। অনেক দিন পর আমি চীন দেশে গেলে খানশা শহরের রাজা কৌশলে আমার পোশাকটি হস্তগত করলেন। কিন্তু পরের বছর আমি যখন পিকিং শহরের বুরহান উদ্দিন সাগরজীর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম তখন ওই জোব্বাটি গায়ে দিয়ে তাকে কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করতে দেখে চমকে উঠলাম। আমি অবাক আর বিস্ময়ে জোব্বাটি বারবার হাত দিয়ে পরীক্ষা করছি দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বারে বারে দেখেছ কি? জোব্বাটি চেন নাকি?’ আমি সব কথা খুলে বললাম। ‘আমার দোস্ত জালাল উদ্দিন এটি আমার জন্যেই তৈরি করেছিলেন। এটি কীভাবে পৌঁছাবে তাও তিনি চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছেন।’ এই কথা বলে তিনি জালাল উদ্দিনের চিঠি খুলে দেখালেন। পত্রখানি পড়ে দরবেশের অলৌকিক নিদর্শন পেয়ে আমি হতবাক হলাম।’
ইবনে বতুতা পরবর্তী সময়ে হজরত শাহজালাল (রহ.) এর সহচরদের সঙ্গে আলাপ করে হজরতের জীবনযাত্রা এবং তার ওফাত সম্পর্কে যে বিবরণ পেয়েছিলেন তাও তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে লিখে গেছেন। এতে হজরত শাহজালাল (রহ.) সম্পর্কে লেখা আছে, তিনি জীবনের শেষ ৪০ বছর অনবরত রোজা রাখতেন এবং প্রতি ১০ দিন অন্তর নিজের গাভীর সামান্য দুধ পান করতেন। তিনি সারা রাত দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তেন। স্থানীয় অধিবাসীরা তার কাছেই ইসলাম কবুল করে। তিনি অত্যন্ত কৃশ ও লম্বা ছিলেন। মুখে অল্প গোঁফ-দাড়ি ছিল। ওফাতের আগের দিন তিনি মুরিদদের ডেকে বলেন, ‘আল্লাহর হুকুমে কাল আমি তোমাদের ছেড়ে চলে যাব। আল্লাহর উপর ঈমান রেখো। তিনি-ই তোমাদের রক্ষা করবেন।’
পরের দিন জোহরের নামাজের শেষ সেজদার সঙ্গে সঙ্গে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আল্লাহ তার ওলিকে নিজ কোলে টেনে নিলেন। তার হুজরার পাশে তার জন্য কাফন, আতর ও একটি কবর খোদিত অবস্থায় পাওয়া গেল। তার মুরিদরা যথারীতি গোসল করিয়ে তাকে সেখানে কবর দেন। আল্লাহ তার পবিত্র আত্মার শান্তি বিধান করুন।