আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ২০-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

কোরআনের বসন্তকাল রমজান

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
| প্রথম পাতা

রমজান মাসের পরিচয় সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রমজান মাস, যে মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে...(সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৫)’ সূরা কদরে আল্লাহ পাক বলেন, ‘আমি কদরের রাতে কোরআন নাজিল করেছি।’ সাধারণত ধারণা করা হয় যে, রমজান মাস তথা লাইলাতুল কদরে  কোরআন মাজিদ  নাজিলের সূচনা হওয়াতে রমজান মাসের বা শবেকদরের এত ফজিলত। কিন্তু মুফাসসিরদের বক্তব্য হলো, রমজান মাসের নিজস্ব ফজিলতের কারণেই আল্লাহপাক কোরআন মাজিদ নাজিলের জন্য এ মাসকে বাছাই করেন। শুধু কোরআন মাজিদ নয় অন্য তিনটি প্রধান আসমানি কিতাব; তাওরাত, যবুর এবং ইঞ্জিলও রমজান মাসেই নাজিল হয়।  

প্রতি বছর রমজানে আল্লাহর ওহিবাহক ফেরেশতা হজরত জিব্রাঈল (আ.) কোরআন মাজিদের যতখানি ঐ পর্যন্ত নাজিল হয়েছে একত্রে নবী করিম (সা)-কে পড়ে শোনাতেন। আর নবী করিমও (সা.) ওইটুকু জিব্রাঈল (আ)-কে পড়ে শোনাতেন। মাদ্রাসা ছাত্রদের পরিভাষায় একে ‘কোরআন দাওরা’ করা বলা যাবে। কুরআন মাজিদ নাজিলের সূচনা ও জিব্রাঈল (আ.)-এর সঙ্গে নবীজীর দাওর করার 

সুন্নাতের বাস্তব অনুসরণে মুসলিম জাহানের সর্বত্র তারাবিহ নামাজে কোরআন খতমের নিয়ম চলে আসছে হজরত উমর (রা.)-এর আমল থেকে। এ তারাবিহর কারণে লাখ লাখ হাফেজে কোরআন সৃষ্টি হচ্ছে এবং কোরআন মুখস্থ রাখা ও পড়ার চর্চার সূত্রে কোরআন মাজিদের হেফাজতের অলৌকিক কাজটি সম্পন্ন হচ্ছে। আল্লাহপাক কোরআন হেফাজতের দায়িত্ব নিজের ওপর নিয়েছেন সত্য; কিন্তু আমরা যখন দেখি যে, হাফেজদের মাধ্যমে সেই হেফাজতের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হচ্ছে, তখন হাফেজদের সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে ভেবে অবাক হয়ে যাই। 
নিজস্ব ধর্মগ্রন্থ আগাগোড়া পাঠ করার এমন ব্যবস্থা একমাত্র সত্যধর্ম ইসলামেই আছে। পৃথিবীর বুকে কোরআন ছাড়া অবিকৃত ধর্মগ্রন্থ কোনো জাতির কাছে  নেই। ধর্মগ্রন্থ নিয়ে এভাবে চর্চার ব্যবস্থাও তাদের মাঝে নেই। এ কারণেই কোরআন মাজিদ ছাড়া অন্য কোনো ধর্মগন্থের হাফেজ বা মুখস্থকারীও দুনিয়াতে নেই। চিন্তা করলে দেখা যাবে, তারাবিহ নামাজ ও কোরআনের বসন্তকাল রমজানের বরকতে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন হেফাজতের এ ব্যবস্থাপনা এবং  কোরআন মাজিদ জগতবাসীর হেদায়াতের আলোকবর্তিকা হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে। 
তারাবিহ নামাজের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর মনের কামনা রমজান মাসে একবার পুরো কোরআন খতম করা। কেননা, হাদিস শরিফের ভাষ্য অনুযায়ী কোরআন মাজিদের একটি অক্ষর তেলাওয়াত করলে কমপক্ষে ১০টি নেকি লাভ হয়। আর তা যদি রমজানে হয় ৭০ গুণ বেড়ে যায়। অর্থাৎ রমজান মাসে প্রতি অক্ষর কোরআন তেলাওয়াতের জন্য ৭০০টি করে সাওয়াব বরাদ্দ হয়, যা অন্য মাসে লাভ করা অসম্ভব।
প্রশ্ন হলো, কুরআন তেলাওয়াতের জন্য আমরা যেভাবে যতœবান কোরআন মাজিদ অধ্যয়ন ও সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও নিজের ব্যক্তিগত ও সমাজজীবনকে তার আলোকে সাজানোর জন্য সে রকম কোনো উদ্যোগ কি আমরা গ্রহণ করেছি বা এর জন্য কোনো প্রস্তুতি আমাদের মাঝে আছে? এ প্রশ্নের সদুত্তর আমরা কেউ দিতে পারব বলে মনে হয় না।  
উল্লেখিত আয়াতে কোরআন মাজিদের পরিচয় হলো, ‘হুদান লিন্নাস’ মানব জাতির জন্য পথনির্দেশিকা। কোরআন থেকে পথনির্দেশ লাভের কোনো উদ্যোগ কি আমাদের মধ্যে আছে কিংবা গোটা মানব জাতির মধ্যে কোরআনের বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব চেতনা কি আমরা লালন করি? পাক কোরআনে মানবজীবনের অতীত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানের সব কিছু বিবৃত হয়েছে। মানব সৃষ্টির সূচনা, হজরত আদম (আ)-এর বেহেশতে হতে দুনিয়ায় আগমন, যুগে যুগে মানব জাতির হেদায়াতের জন্য নবী রাসূলদের আগমন ও ভূমিকার ইতিহাস জানার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে কোরআন মাজিদ। মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় আইন ও নিয়ম-কানুন বিবৃত হয়েছে কুরআন মাজিদে। হজরত নবী করিম (সা) চরম প্রতিকূল পরিবেশে কীভাবে মানুষকে আল্লাহর পথে এনেছিলেন, কাফির, মুশরিক ও শত্রুদের কীভাবে মোকাবিলা করেছেন তার ইতিহাসের আকর গ্রন্থ কোরআন মাজিদ। 
মহানবী (সা) যেভাবে হিজরত করে জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় গেলেন, মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা করে কিভাবে ইসলামের দাওয়াত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেন, বদর, উহুদ, খন্দক, হুনাইন ও তাবুক যুদ্ধে কিভাবে শত্রুদের মোকাবিলা করেন তার ইতিহাস ও বিশ্লেষণ কোরআন মাজিদে বিদ্যমান। আমাদের পারস্পরিক লেনদেন, সালাম বিনিময়, কার কার সঙ্গে বিয়ে-শাদি হতে পারবে বা পারবে না, উত্তরাধিকার সম্পত্তির বন্টন ব্যবস্থা, অপরাধ প্রতিরোধে দ-বিধি প্রভৃতি মানব জীবনের এমন কোনো বিষয় নেই, যা কোরআন মাজিদে বর্ণিত হয়নি। 
আমরা যদি কোরআন মাজিদ হতে সত্যিকার হেদায়াত ও বরকত লাভ করতে চাই, অবশ্যই কোরআন মাজিদের অর্থ বুঝার এবং তার আলোকে আমাদের নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে উন্মুক্ত তথ্যপ্রবাহের এ যুগে ইন্টারনেটের নীল সন্ত্রাসের আক্রমণে যখন আমাদের সন্তানদের জীবন চরম ঝুঁকির মধ্যে, তখন তা থেকে নিস্তারের একমাত্র পথ হতে পারে কুরআনের শিক্ষাকে জীবনে ধারণ করা। শুধু ওয়াজ মাহফিল বা মাদ্রাসায় নয়; স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের জন্য কোরআন শিক্ষা সিলেবাসভুক্ত করার চিন্তা করা প্রতিটি সচেতন নাগরিকের কর্তব্য। এর সমান্তরালে অন্য ধর্মের অনুসারীরা তাদের ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করলে ধর্মীয় বৈচিত্র্যের মাঝে একটি আদর্শ সমাজের আবহ তৈরি হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।