আমাদের দেশে কৃষক ভালো নেই। দেশে বছর বছর মানুষ বাড়ছে। আবাদি জমি কমছে। বাড়তি জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাচ্ছে দেশের কৃষক। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমাদের কৃষকের নিজেদের জমি নেই, তার মালিকানা ধনিকশ্রেণির হাতে। কৃষকের উৎপাদনে মূল্যও নির্ধারণ করে এই সামন্তবাদীরা। অর্থাৎ কৃষির জন্য মাটি, আর প্রযুক্তির জন্য যে বিজ্ঞান তাকে ব্যবহার করে আসে আমাদের উৎপাদন। যার কারিগর দেশের কৃষক। এই উৎপাদনকে ভোগ-ব্যবহার করতে গিয়ে আরেক দফা লোকসানের মহরত গোনে কৃষক। এজন্য অনেক ধান ফলিয়েও কৃষকের সুখ আসে না। তারা জমিতে উৎপাদনের জন্য শক্তি ক্ষয় করে। তাকে মূল্য আদায়ে বিক্রি করতেও প্রতিবাদের কসরৎ দেখাতে হয়।
ব-দ্বীপের বদৌলতে আমরা মানুষ হিসেবে বাঙালি পরিচয় পেয়েছি। হাজারো নদী স্রোতের জন্য ভিজা মাটির মালিকানা পেয়ে কৃষি সম্পদের পাহাড়সম উৎপাদন পেয়েছি। এদেশের মাটিতে যে রস থাকে তাতে সব সময়ে বীজ ছিটিয়ে দিলেই ফল ও ফসল জন্ম নেবেÑ এটাই স্বাভাবিক। আমাদের মাটিতে ফসল, পানিতে ফসল আবার মাটির উপরে জন্ম নেয় ফলও। কৃষিতে আমাদের সফলতা আছে। কৃষকের ঘাম ঝরে কৃষি ক্ষেত্রে। রোদ, ঝড়, শীত, বৃষ্টি, শৈত্যপ্রবাহ, তাপপ্রবাহ, বজ্রবাণকে সঙ্গে নিয়ে কৃষকের জীবন। দেশ যখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ তার পুরো অবদান কৃষকের। আগে কৃষি ছিল প্রাকৃতিক। এখন কৃষিতে এসেছে আধুনিক চাষাবাদ। অর্থাৎ কৃষিতে বৈশিষ্ট্যে যে পরিবর্তনই আসুক না কেন, তা নির্ভরশীল হয়ে আসে প্রকৃতিকে নিয়েই।
মানুষ জন্ম নেওয়ার পরে প্রথম গুহা থেকে বেরিয়ে এলো। শিকার বেয়ে বেয়ে একসময় নিজের বুদ্ধি এবং শরীরের অঙ্গগুলোকে উজাড় করে বিলিয়ে দিয়ে তার রূপ-রস সৃষ্টি করে সামনে হাজির করল ‘উৎপাদন’কে। এই উৎপাদন নামের যে উপযোগ তার কারিগর হলো আমাদের কৃষক। এরা প্রকৃতির বস্তুগত উপাদানকে মানুষ বা নিজেদের জন্য ভোগ সাবলীল করতে উপায়কে সক্রিয় করতে প্রথাকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হলো। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যে অবদান শুধুই কৃষকের। ফসল উৎপাদনে সে রোদ, বৃষ্টি, শীত, ঝড়, বজ্রবাণের ঝুঁকিতে তার শরীরের ঘাম ঝরায়। কৃষকের ওপর নির্ভর করে মানুষ তার প্রয়োজনের প্রতিটি উপকরণ পেয়ে থাকে। আদিতে কৃষি ছিল প্রকৃতির, এখন কৃষি হলো চাষাবাদে। তা-ও তা করতে হয় প্রকৃতিকে মান্য করেই।
আমাদের দেশে প্রতি বছর ৮০ হাজার একর জমি কৃষি ক্ষেত্র থেকে বিদায় নিচ্ছে। আবার বছরে ২৫ লাখ মানুষ মোট জনসংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। সংগত কারণেই কৃষিতে বাড়ছে ঝুঁকি। ১৯৫০ সালের শুরুতে এ দেশে মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশ কম কৃষক ছিল ভূমিহীন, যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৬০ শতাংশে। কৃষক দরিদ্র হয়েছে। কৃষক তার পেশা বদলে ফেলেছেন। কৃষিতে যখন বাম্পার উৎপাদন হচ্ছে, তখনও কৃষক বেঁচে থাকে অপরিপূর্ণ উদরে। দেশে প্রায় ২.২৫ কোটি একর ফসলি জমি আছে। আরও আছে বন, চর, জলাশয়, ফলের বাগান ইত্যাদি। প্রতি বছর ফসলি জমি কমছে ৬৮.৭ হাজার হেক্টর। আবাসন, নগরায়ণ, শিল্পায়ন এর জন্য দায়ী। বিগত দশকের চেয়ে বর্তমান দশকে এ হার বেড়েছে ৫ গুণ হারে, আবার তা ফসলি জমি। জমি কমে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক। দিন বদলে দিন এলেই মানুষ বাড়ছে ২৫ লাখ করে এবং এ মানুষ মোট জনসংখ্যায় যোগ হয়ে জমির ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। যেজন্য বাড়ছে দরিদ্রতা, রাজনৈতিক বৈষম্য, আইনের সুবিধা দিতে জটিলতা, পেশিশক্তির প্রভাব, পুঁজির আগ্রাসন, দেশ ও সমাজের বৈষম্য বাড়িয়েছে। তবে কৃষকের জন্য এজন্য প্রয়োজন উৎপাদিত পণ্যের বাজার এবং পণ্যের ন্যায্যমূল্য।
গবেষণা তথ্য বলছে : ১৯৭৬ সালে দেশে ফসলি জমি ছিল ৯৭ লাখ ৬১ হাজার ৪৫০ হেক্টর। ২০০০ সালে দেশে ফসলি জমি হলো ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার ৫৪১ হেক্টর। কমল ৩ লাখ ২১ হাজার ৯০৯ হেক্টর।
২০১০ সালে জমি ৮৭ লাখ ৫১ হাজার ৯৩৭ হেক্টর। অর্থাৎ ১৯৭৬ থেকে ২০০০ সাল সময় পর্যন্ত জমি ফসলশূন্য হয় ০.১৩৭ শতাংশ। আবার ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ে ফসলশূন্য হয় ০.৭২৮ শতাংশ।
আমাদের দেশে সামন্তবাদী কৃষি ব্যবস্থা। কৃষির মাঠে জমির মালিকানা একজনের আর জমিতে উৎপাদন করে আরেকজন। জীবন ঝুঁকি, ঘাম, রক্তকে জল, আর্থিক লোকসান সব কিছুই কৃষকের। আর লাভের বিষয়টুকু শুধুই সামন্তবাদী ভূমি মালিকের। যেজন্য দেশে বস্তি বাড়ছে, বাড়বেই। দেশে ভাসমান মানুষ যতই বাড়বে ততই প্রান্তিক কৃষক তার পেশা বদল করবে।
কৃষকের ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য স্থানীয় বাজারের ওপরে নির্ভর করতে হয়। পুঁজি সংগ্রহের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বাইরে পুঁজি নিতে গেলে তাকে দিতে হয় চড়া সুদ। আবার জমির মালিকের মর্জির ওপর নির্ভর করে কৃষককে চাষের জন্য ফসল সিলেকশন করতে হয়। আইনি কাঠামো যাই থাক না কেন ‘ন্যায্যমূল্য’ এখনও আমাদের দেশে কৃষকের জন্য ব্যবহৃত হয়নি।
কৃষক কিনতে গিয়ে ঠকে। বিক্রি করেও সে ঠকে। কৃষকের জন্য প্রকৃতি, সমাজ, আইন, বিধি, রাষ্ট্র সর্বস্থানে বেহিসেবে প্রাপ্তি। যদিও দেশের বাজার ব্যবস্থাপনায় কৃষকের পণ্যের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রক হলো ক্রেতা ও ভোক্তা। তবে এ দুই খাতের মাঝে হাত ঢুকিয়ে শ্রম না করে শুধু মুনাফা আয় করে নেয় যে স্বত্বভোগীরা তার সংখ্যা নেহাত কম নয়। তবে এই মাঝপথের জন্য যে ভোগান্তি এবং মূল্যবৃদ্ধি তার মাশুল দেয় ভোক্তা। অর্থাৎ কৃষকের শ্রম থেকে ভোক্তার পকেট শূন্যতা পর্যন্ত যে লাভের কড়ি তা যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে।
বিজ্ঞান এগিয়ে যাচ্ছে। সময়ের ব্যবধানে প্রযুক্তি নিত্যনতুন রূপ ও গুণ নিয়ে ফিরে আসছে। এই রূপায়ণ করতে গিয়ে পুঁজিপতিরা প্রযুক্তিকে মুনাফা তৈরির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এতে উৎপাদন বাড়লেও প্রকৃতির ক্ষয় বাড়ছে। প্রযুক্তি দিয়ে মাটিকে উৎপাদনে সক্রিয় করতে গিয়ে মাটির শক্তিকে ক্ষয় করা হচ্ছে। মাটির সঙ্গে সঙ্গে বলহারা হচ্ছে আমাদের কৃষকও।
সভ্যতার আদিপর্বে মানুষ তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য যে আকাক্সক্ষার সৃষ্টি করে তা পূরণের জন্য সামনে আসে আবিষ্কৃত প্রযুক্তি। প্রাকৃতিক সম্পদকে শোষণ করে আসে মুনাফা। আর এই মুনাফা করতে গিয়ে আসে নতুন নতুন প্রযুক্তি। প্রকৃতির বস্তু জগতের অর্জন করা জ্ঞান যখন মানুষের তাগিদে প্রয়োজন হয়, তখন তা হয় প্রযুক্তি।
উইলিয়াম পেট্রিক বলেছেন, ‘ব্যবহারিক মূল্যযুক্ত সম্পদের জনক শ্রম।’ এই সংজ্ঞার আলোকে আমরা বলতেই পারি তাহলে ওই শ্রমের উদ্ভাবক অবশ্যই আমাদের কৃষক। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৬২ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষিতে। শ্রমের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেলে বাড়ে দরিদ্রতা।
পুঁজিবাদী বা সামন্তবাদীরা প্রাকৃতিক সম্পদকে লুট করে। আর এই কারণে প্রাকৃতিক ক্ষয় বাড়ছে। প্রান্তিক কৃষক তার প্রয়োজনের কারণে প্রকৃতিকে উৎপাদনের জন্য সক্রিয় করে এবং তা করতে গিয়ে প্রকৃতিকে রূপায়ণ করে। যেজন্য প্রকৃতির রূপে বিন্যাস সৃষ্টি হয়। ভোগবাদীদের ক্ষয়ের চেয়ে কৃষকের এ রূপায়ণ বা উৎপাদন অনেক ভালো।
গৌতম কুমার রায়
প্রাবন্ধিক, উদ্ভাবক-গবেষক ও পরিবেশ ব্যক্তিত্ব