আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ২১-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

কৃষকের বোরো ধানের মূল্যপ্রাপ্তিতে কিছু পরামর্শ

ড. মো. হুমায়ুন কবীর
| সম্পাদকীয়

বাংলাদেশে ধান-চালের চাহিদার একটি বিরাট অংশ আসে বোরো মৌসুমে প্রাপ্ত ধান থেকে। কাজেই বোরো মৌসুমে কৃষকের কষ্টার্জিত এবং বহু মূল্যের বিনিময়ে উৎপাদিত ধানের দাম না পাওয়া এখন একটি সাধারণ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। অর্থনীতির সাধারণ একটি সূত্র হলোÑ কোনো পণ্যের সরবরাহ যত বেশি হবে চাহিদা তত কমবে এবং মূল্যও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমবে। যে কোনো ফসলের ক্ষেত্রেই উৎপাদন মৌসুমে এমনটিই হতে দেখা যায়। তবে বাংলাদেশের প্রধান ফসল এবং প্রধান খাদ্য যেহেতু ধান, সেজন্য উৎপাদন মৌসুমে এর মূল্যের একটি যৌক্তিক ভিত্তি থাকাটা খুবই জরুরি। 
বিশ্লেষণে দেখা যায়, উৎপাদন মৌসুমে বোরো ধানের মূল্য কম থাকার কিছু কারণ বিদ্যমান রয়েছে। পুরো মৌসুমে কৃষক বোরো ধানের উৎপাদনের জন্য তার সারা বছরের সঞ্চয় বিনিয়োগ করে ফেলে। অনেক কৃষকের সেই জমানো টাকায়ও খরচ মেটে না। সে জন্য তাকে মহাজন কিংবা দাদন ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হতে হয়। ফলে মৌসুম শেষে কৃষক ঋণের ভারে দিশাহারা হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় যে কোনো মূল্যে ধান বিক্রি করে নগদ টাকা হাতে নিয়ে ঋণ পরিশোধ করা কৃষকের একটি দায় হিসেবে দেখা দেয়। সেই সুযোগটাই ফড়িয়া, দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীরা নিয়ে থাকে। তখন কৃষক কম মূল্যে তার উৎপাদিত ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। 
অন্যদিকে দেখা যায়, সরকারি ক্রয় শুরু হয় একটু পরের দিকে অর্থাৎ তখন কৃষক তার সমস্যা যথারীতি তাদের আর্থিক ক্ষতি করেই কাটিয়ে ওঠে। তাছাড়া সরকার সরাসরি ধান কৃষকের কাছ থেকে না কিনে স্থানীয় চাতাল ব্যবসায়ী বা মিল মালিকদের কাছ থেকে কেনে। সে জন্য মিল মালিকরাও সেই সুযোগে কৃষকের আর্থিক অনটনকে পুঁজি করে কম মূল্যে সেই ধান কৃষকের কাছ থেকে আগেভাগেই কিনে নেয়। আর সরকার শুকনো ধান কিনে থাকে। অর্থাৎ গুদামজাত করতে হলে যেভাবে শুকিয়ে ধান বিক্রি করতে হয়, সেখানে কৃষক তাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য তত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে না। কাজেই সদ্য সংগৃহীত কাঁচা ধান সরাসরি মাঠ থেকেই তা কমদামে বিক্রি করে দিচ্ছেন কৃষক। 
উৎপাদন মৌসুমে দেশের সব স্থানেই প্রায় একই সময়ে ধানকাটা শুরু হয়। তাই ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যা-ও পাওয়া যায় তার জন্য আবার অধিক মূল্য পরিশোধ করতে হয়। সে জন্য জমির ভাড়া, সার ও শ্রমের মূল্য, সেচ ও আবাদ বাবদ খরচ মিলে মণপ্রতি ধান উৎপাদনে যে খরচ হয় (৭০০ থেকে ৮০০ টাকা) তাৎক্ষণিক বিক্রি করলে (৫০০ থেকে ৬০০ টাকা) তাতে কৃষকের লোকসান গুনতে (মণপ্রতি প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা) হয় সত্য। কিন্তু সেই ধানই যদি আবার নির্ধারিতভাবে শুকিয়ে এবং কিছুদিন (মাত্র ১ থেকে ২ মাস পর) সংরক্ষণ করার পর বিক্রি করা যায় তাহলে এর সঠিক ও লাভজনক মূল্যটা কৃষক পেতে পারে। 
বর্তমানে যে পরিমাণ ধান অর্থাৎ ১২ লাখ ৫০ হাজার টন মাত্র সরকারিভাবে ক্রয় করা হয়, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এর কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে, দেশে বর্তমানে এর থেকে বেশি ধান-চাল সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় গুদাম বা সাইলো নেই। কিন্তু আমরা জানি, এখন সরকারের আর্থিক সক্ষমতা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অগ্রসরমান। কাজেই দেশের স্বার্থে এবং দেশের কৃষকের স্বার্থে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার পরিমাণ বর্তমানের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি করতে হবে। সে জন্য সারা দেশে সংরক্ষণাগার প্রয়োজনীয় সংখ্যক বৃদ্ধি করতে হবে। তাছাড়া সরকার যেখানে বর্তমানে সরাসরি মিল মালিকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করে থাকে; সেখানে আগামীতে তা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কিনতে হবে। অবশ্যই কৃষকের ক্ষেত থেকে কাঁচা ধান কেনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় কাঁচা ধানের জন্যও একটি যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। 
এ বছর (২০১৯) সরকারিভাবে শুকনো ধান ২৬ টাকা কেজিতে এবং সিদ্ধ চাল ৩৬ টাকা কেজি এবং আতপ চাল ৩৫ টাকা কেজি দরে কেনা হচ্ছে। সরকারিভাবে ক্রয়ের জন্য দামের ব্যাপারে অবশ্য কারোর তেমন কোনো আপত্তির কথা শোনা যায়নি। শুধু অপত্তি হলো পরিমাণ, সময় ও পদ্ধতির ওপর। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের তরফ থেকে এ সমস্যা সমাধানের জন্য অবশ্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। সেখানে যে কোনো মুহূর্তে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সে জন্য প্রচুর পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য মজুত করে রাখতে হয়। আর যে বছর তা হয় না, তখন তা গুদামেই নষ্ট হয়ে যায়। সে জন্য চাল বিদেশে রপ্তানির বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। 
তবে যাই হোক না কেন, এসব চিন্তাভাবনা বা পরিকল্পনা করতে হবে মৌসুম শুরু হওয়ার একটি যৌক্তিক সময়ের আগেই। কারণ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কৃষকরতœ শেখ হাসিনার একটি অন্যতম সেøাগান হলোÑ ‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে’। কাজেই এর মর্মার্থ উপলব্ধি করেই সবাইকে কাজ করতে হবে। অন্যথায় কৃষক এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতেই থাকবে। বোরো ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার জন্য সরকারি ব্যাংকগুলোকে আরেকটু এগিয়ে আসা দরকার। এমনিতেই তারা কৃষকের কল্যাণে অনেক কিছু করে যাচ্ছে সত্য। যেমন মাত্র দশ টাকা দিয়ে কৃষককে ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ দিয়েছে সরকার। অন্যদিকে কৃষকের উৎপাদনের জন্য সার, বীজ, সেচসহ সব ধরনের কৃষি খাত ও উপকরণে সরকার ভর্তুকি এবং প্রণোদনা দিয়ে থাকে। সেখানে উৎপাদন খরচ অনেকংাশে কমে আসে। 
এত কিছু যেহেতু কৃষকের ভালোর জন্যই করা হচ্ছে, সে জন্য আরও কিছু কাজ অবশ্যই করা প্রয়োজন। বোরো ধানের সঠিক মূল্য পাওয়ার জন্য সরকারি ক্রয়, বিদেশে রপ্তানি, গুদাম বা সাইলো তৈরি করতে হবেÑ সেগুলো একটু সময় সাপেক্ষ। কিন্তু কৃষকের মূল্য পাওয়ার বিষয়টি এখনই নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আর তা এ মৌসুমে হয়তো করা সম্ভব হবে না। তাই আগামী বছর (২০২০) করার জন্য তা এখন থেকেই নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। সেটি নিশ্চিত করার জন্য ধান কাটার মৌমুমে যাতে পানির দামে কৃষককে ধান বিক্রি করতে না হয় এবং তা যেন কমপক্ষে ২-৩ মাস রেখে পরে বিক্রি করতে পারে, সে জন্য তাকে স্বল্পসুদে, বিনাশর্তে, অল্প পরিমাণে, স্বল্পমেয়াদি কৃষি ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে জমির মালিকের পাশাপাশি বর্গা চাষিকেও সমানভাবে বিবেচনা করতে হবে। 
যদি কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনা হয় কিংবা কৃষককে আপৎকালীন সময়ের জন্য বিশেষ কৃষিঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়; তবে তা আগেভাগেই কৃষকের মাঝে প্রচার করতে হবে, যাতে এর সুযোগ আর কেউই নিতে না পারে। এ বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি সারা দেশে একটি সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা মনে করে থাকি কৃষকের কোনো সংগঠন নেই; তাই কৃষকের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। সে জন্য দেখা গেছে, টাঙ্গাইলের এক কৃষক শ্রমিকের অভাবে ধান কাটতে না পেয়ে এবং উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার আশঙ্কায় তার ধানক্ষেতে নিজেই আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন। সেটি দেখে দেশজুড়ে কৃষকের সন্তান পরিচয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত ধানের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির জন্য মানববন্ধন করেছেন। কাজেই বিষয়টি এখন আগের তুলনায় অনেক গণমুখী হওয়ায় সে বিষয়ে কার্যকর সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ প্রত্যাশিত।
 
 ড. মো. হুমায়ুন কবীর
কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
শনফযঁসধুঁহ০৮@মসধরষ.পড়স