আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ২১-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

অবৈধ পথে বিদেশযাত্রায় আর কত প্রাণহানি?

মাছুম বিল্লাহ
| সম্পাদকীয়

ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের তিন মাসে লিবিয়া থেকে সাগরপথে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন এমন অভিবাসীদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ মে পর্যন্ত ১৭ হাজার অভিবাসী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছেছেন। এই যাত্রাপথে প্রায় ৫০০ অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে

৯ মে রাতে লিবিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জুয়ারা উপকূল থেকে একটি বড় নৌকা ইতালির উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। গভীর রাতে ভূমধ্যসাগরে তিউনিশিয়ার জলসমীমায় ওই বড় নৌকা থেকে প্রায় ৭৫ জনকে একটি ছোট নৌকায় নামানো হয়, যা রাবারের তৈরি ‘ইনফ্লেটেবেল’। ছোট নৌকায় নামানোর দশ মিনিটের মধ্যে নৌকাটি ডুবে ৬০ জনের মৃত্যু ঘটে, তাদের মধ্যে ২৭ জনই বাংলাদেশি। উদ্ধারকৃত ১৭ জনের মধ্যেও ১৪ জন বাংলাদেশি। নৌকাটি ডুবে যাওয়ার পর তারা প্রায় আট ঘণ্টা ঠান্ডা পানিতে ভেসেছিলেন। এ সংবাদ আমাদের ব্যথিত, মর্মাহত, উদ্বিগ্ন এবং লজ্জিতও করে। কারণ আমাদের স্বাধীন ও সম্ভাবনাময় দেশ থেকে কর্মঠ তরুণরা বিদেশে যাবে; কিন্তু এভাবে কেন? দেশি-বিদেশি দালালচক্র গভীর সমুদ্রে একটি ছোট্ট নৌকায় এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে তুলে দেয় অথচ নৌকাটি গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে কি না, যাত্রীরা বেঁচে থাকবে কি না, সেসব নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা থাকে না, কারণ তারা দালাল, তাদের দরকার শুধু অর্থ। এ দালাল চক্রের একমাত্র লক্ষ্য অর্থ উপার্জন। সমুদ্রে যাত্রার আগে লিবিয়ার একটি অস্বাস্থ্যকর ঘরে তিন মাস গাদাগাদি করে তাদের রাখা হয়েছিল। এ কেমন অবমাননাকর কথা? যেসব দেশে বেকারত্ব বেশি, সেসব দেশকে যে এ দালালচক্র লক্ষ্যবস্তু করে, ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া নৌকার আরোহীদের পরিচয়ই তার প্রমাণ। আমাদের দেশে তরুণদের, বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের করার তো অনেক কিছু আছে, তারপরও তারা কেন এ মরীচিকার পানে ছুটছে?
এভাবে সমুদ্রে ডুবে বাংলাদেশি অভিবাসীদের মৃত্যুর ঘটনা প্রথম নয়। কয়েক বছর আগে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে বহু বাংলাদেশি সাগরে ডুবে মারা গেছে। শুধু সমুদ্রপথে নয়, দুর্গম মরুপথে, তুষারপথে ও বনজঙ্গল পার হতে গিয়েও অনেকে মারা গেছে। যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছায়, তাদেরও হয় পালিয়ে থাকতে হয়, কিংবা ঠাঁই হয় কারাগারে। যারা ভাগ্যান্বেষী তরুণদের সোনার হরিণের স্বপ্ন দেখিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল, তারা প্রায়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। তাদের নেটওয়ার্ক অনেক বেশি বিস্তৃত। এ চক্রের শিকড় উৎপাটন করতে না পারলে সমুদ্রে বা মরুপথে মানুষের মৃত্যুস্রোত ঠেকানো যাবে না। অতীতে বৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ না পেয়ে অনেকে অবৈধ পন্থায় দেশটিতে যাওয়ার প্রয়াস চালিয়েছে এবং পরে থাইল্যান্ডের গহিন অরণ্যে অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের গণকবর আবিষ্কৃত হলে বিশ্বজুড়ে হইচই শুরু হয়। সে সময় মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকেও অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের উদ্ধার করা হয়েছিল। এ অবস্থায় সরকারের উচিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন শ্রমবাজার খোঁজার পাশাপাশি চলমান শ্রমবাজারগুলোয় নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করা। একই সঙ্গে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার ব্যাপারেও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক বাজারে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে আমাদের দেশ থেকে যে জনশক্তি রপ্তানি হয়, তাদের অধিকাংশই আধাদক্ষ বা অদক্ষ পর্যায়ের। কাজেই দেশে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির উপযুক্ত প্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 
ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের তিন মাসে লিবিয়া থেকে সাগরপথে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন এমন অভিবাসীদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ মে পর্যন্ত ১৭ হাজার অভিবাসী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছেছেন। এই যাত্রাপথে প্রায় ৫০০ অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের দ্বিতীয়ার্থে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছানো অভিবাসীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি রয়েছেন। অদক্ষ হওয়ার কারণে এসব শ্রমিকের মজুরির পরিমাণ হয় খুবই কম। ফলে জমিজমা বিক্রি বা ঋণ করে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার পর উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও খরচের টাকা ওঠানোই তাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে। এ বাস্তবতা সামনের রেখে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার পাশাপাশি সরকার অবৈধ অভিবাসন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেÑ এটিই আমরা আশা করি। আইওএমসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, লিবিয়ায় নাজুক নিরাপত্তা পরিস্থিতির মধ্যে সেখান থেকে কতজন ইউরোপের উদ্দেশে রওনা করছে আর কতজনই বা পৌঁছাতে পারছে, তা অনুমান করা কঠিন। আন্তর্জাতিক জলসীমায় নৌকাডুবির অনেক ঘটনাই জানা যায় না। তিউনিশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর জারজিসে রেড ক্রিসেন্ট কর্মকর্তা মোনজি সিøম বলেন, ৯ মে যাদের উদ্ধার করা হয়েছে তাদের তিউনিশিয়ার জেলেরা যদি না দেখত, তাহলে হয়তো তারা সগারে ডুবেই মরত। কেউ ওই নৌকাডুবির বিষয়ে জানতেই পারত না। তার অর্থ হচ্ছে অনেক অভিবাসীর ডুবে যাওয়ার মৃত্যুর সংবাদও আমরা জানতে পারি না। 
লিবিয়ায় মাত্র কয়েকদিন, এরপর পেরোলেই ইতালি। সেখানে যা আয় হবে, অন্তত এক মাসেই দেশে বাড়ি করা যাবেÑ এমন প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে কর্মী পাঠাচ্ছে দালালচক্র। অথচ লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার ওই পথটি মধ্য ভূমধ্যসাগরীয় রুট, যা আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার দৃষ্টিতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই পথ দিয়ে ইতালিতে পৌঁছার চেষ্টা করেছেন এমন ৫০ জনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। ইতালি অভিমুখী অভিবাসনপ্রত্যাশী ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এ ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু এড়াতে ভাগ্যান্বেষী তরুণদের যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি সরকারকেও তৎপর থাকতে হবে, যাতে দেশি-বিদেশি দালালরা নিরীহ মানুষকে প্রতারিত করতে না পারে। যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিদেশে পাঠানের নাম করে বেকার ও অসহায় তরুণদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে শুধু দালালদের পাকড়াও করলেই এ সমস্যার সমধান হবে না। এর স্থায়ী ও টেকসই প্রতিকার পেতে হলে দেশের ভেতরেই তরুণদের উপযুক্ত কর্মের সংস্থান করতে হবে। কাতারে পরিচয় হয় বাগেরহাটের দালাল রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। রফিকুলকে প্রলোভন দেখিয়ে দালালচক্র বলে, প্রতি মাসেই ইত্যালিতে উপার্জন করা যাবে দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকা। ইতালি পৌঁছানোর পর দালালকে দিতে হবে সাত লাখ টাকা। উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে ঝুঁকির মধ্যে কাতার থেকে তুরস্ক নিয়ে যায় দালাল সিন্ডিকেট। তার সঙ্গে আরও ১৭ জন বাংলাদেশি। তুরস্কের একটি গুদামে নিয়ে আটকে রেখে টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে দালাল সিন্ডিকেট। জনপ্রতি তিন লাখ টাকা না দিলে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। পরে বাধ্য হয়ে গ্রামের জমি বিক্রি করে পরিবার টাকা দেয় দালাল সিন্ডিকেটের কাছে। তুরস্কে চার দিন রেখে নেওয়া হয় লিবিয়ার একটি উপকূলবর্তী জায়গায়। সেখানেও টাকার জন্য মারধর করতে থাকে। এক লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে নির্যাতন থেকে রক্ষা পান তিনি। ইতালি যাওয়ার আগের ট্রিপটি সমুদ্রে গিয়ে ডুবে যায়। সেটি জেনে ইতালি না গিয়ে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। রাস্তায় দালালরা টাকার জন্য অনেককে পিটিয়ে মেরেও ফেলে। আর এক যুবক সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে ইতালিতে গিয়েছিলেন। দুবাই ও তুরস্ক হয়ে গিয়েছিলেন ইতালি, দালালকে দশ লাখ টাকা দেওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু তিনি সমুদ্রে তার সামনে চারজনকে পড়ে মরতে দেখেছেন। এ সময় তিনি যে ভয় পেয়েছেন আজও তা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ওয়ারবি নামে একটি বেসরকারি সংস্থা অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করছে। তাদের মতে, ‘দালালদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের প্রলোভনের কারণেই অনেকে ইউরোপে পাড়ি জমানোর আশায় মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেয়। তিনটি চক্র যেমনÑ মানব পাচারকারী, ড্রাগ বা গোল্ড স্মাগলার ও দালালরা মিলেই এ ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ কাজটি করছে।’
তিউনিশিয়ার জলসীমায় নৌকাডুবির রেশ কাটতে না কাটতেই ইউরোপীয় দেশ মাল্টার কোস্ট গার্ড অভিবাসনপ্রত্যাশী বোঝাই একটি নৌকা উদ্ধার করেছে। অর্থাৎ গোটা বিশ্বেই চলছে এ অবৈধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজ। লিবিয়া থেকে ইউরোপ অভিমুখে যাত্রা করা ওই নৌকায় ৮৫ অভিবাসনপ্রত্যাশীর বেশিরভাগই বাংলাদেশ ও মরক্কোর নাগরিক বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক বিশেষ দূত ভিনসেন্ট কোচটেল। তিনি ওই ঘটনায় লিবিয়ায় কোস্ট গার্ডের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পাশাপাশি তিনি বলেছেন, উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের বেশিরভাগেরই অন্য দেশে স্থানান্তর নয়, বরং নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এ সংকটের সমাধান হবে। আমরাও তাই মনে করি। তবে বিশ্ব সম্প্রদায়কে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। মানুষকে এভাবে মরতে দেওয়া যাবে না। যারা এ জন্য দায়ী তাদের আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আনতে হবে। 

 মাছুম বিল্লাহ
শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক
বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত [email protected]