আগামী অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটে চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি খরচ করতে চাইছে সরকার। তবে এ প্রস্তাবিত বরাদ্দ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের চাহিদার মধ্যেও বেশ ফারাক রয়েছে। সংসদ নির্বাচনের আগে শেষ মুহূর্তে নেওয়া প্রায় ২০০ প্রকল্প, যেগুলো নতুন এডিপিতে যোগ হতে পারে। এছাড়া পৌনে ২০০ এমন প্রকল্প রয়েছে, যেগুলো চলতি অর্থবছরের মধ্যেই কাজ শেষ করার লক্ষ্য ছিল। কাজ শেষ না হওয়ায় তা আগামী অর্থবছরের এডিপিতে যোগ হচ্ছে। দুই ধরনের মিলে কয়েকশ’ প্রকল্প চাপ বাড়িয়েছে এডিপিতে। এতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য সরকারি ও উন্নয়ন সহায়তা মিলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার দাঁড়াচ্ছে (এডিপি) ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। আজ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় উঠছে নতুন এডিপির প্রস্তাব। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে এ সব তথ্য জানা গেছে।
রাজধানীর এনইসি সম্মেলন কেন্দ্রে আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এনইসি সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে উপস্থাপনের জন্য তৈরি প্রস্তাবিত নতুন এডিপিতে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বরাদ্দ থাকবে ১ লাখ ৩০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। প্রকল্প সহায়তা হিসেবে বিদেশি উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এর বাইরে ১২ হাজার ৩৯২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো নিজেদের তহবিল থেকে ব্যয় করবে। ফলে বাস্তবায়নকারী সংস্থার তহবিল ধরলে মোট এডিপির আকার দাঁড়াবে ২ লাখ ১৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের শুরুতে ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকার এডিপি অনুমোদন পায়। এতে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বরাদ্দ ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্প সহায়তা হিসেবে ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার তহবিল থেকে ৭ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। সে হিসেবে চলতি বছরের এডিপির তুলনায় নতুন এডিপির আকার বাড়ছে ৩৪ হাজার ২৪৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। শতকরা হিসেবে উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়ছে প্রায় ১৯ শতাংশ।
জানা গেছে, নতুন এডিপি প্রণয়নকালে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মিলে সরকারের তহবিল ও বিদেশি সহায়তা বাবদ ২ লাখ ৫৩ হাজার ২১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা চেয়েছিল। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার ৯৯৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ও বিদেশি সহায়তা বাবদ চাহিদা ছিল ৭২ হাজার ২৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এ দুই খাতে ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। সে হিসেবে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে চাহিদার তুলনায় ৫০ হাজার ৭৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা কম বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। বিদেশি সহায়তায় বরাদ্দের ঘাটতি থাকছে ২২৪ কোটি টাকা।
মোট প্রকল্প : ২০১৯-২০ অর্থবছরের এডিপিতে মোট এক হাজার ৪৭৫টি প্রকল্প থাকবে। এর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প এক হাজার ৩৫৮টি। কারিগরি সহায়তা প্রকল্প থাকবে ১১৬টি। এ ছাড়া বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন ৮৯টি প্রকল্প এডিপিতে যুক্ত হবে। মোট প্রকল্প সংখ্যা দাঁড়াবে এক হাজার ৫৬৪টি।
চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে অনুমোদন দেওয়া হয় চার শতাধিক প্রকল্প। এর মধ্যে গেল সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ওই সরকারের শেষ কয়েক মাসে তড়িঘড়ি করে নেওয়া প্রায় ২০০ প্রকল্পও রয়েছে। সবচেয়ে বেশি অনুমোদন হয় অক্টোবর ও নভেম্বরে। এর মধ্যে ২ অক্টোবরের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ১০টি, ৯ অক্টোবর ১৪টি, ১১ অক্টোবর ১৪টি, ২৩ অক্টোবর ১৯টি, ৩০ অক্টোবর ১৯টি, ৪ নভেম্বর ৩১টি, ৭ নভেম্বর ১৯টি নতুন প্রকল্প অনুমোদন পায়। গেল অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে নামমাত্র বরাদ্দ ছিল এসব প্রকল্পে। তাই এসব প্রকল্পের শুরু থেকেই গতি ধরে রাখতে প্রয়োজন হবে বিপুল পরিমাণের অর্থ। তবেই আগামী বছর এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মুখ দেখবে।
চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এডিপিতে সম্ভাব্য সমাপ্ত প্রকল্পের সংখ্যা ছিল ৪৪৬টি। জুনের মধ্যে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ২৭২টি প্রকল্প জুনে শেষ হচ্ছে না। এ জন্য প্রকল্পগুলোকে আগামী অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ সব প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হবে। এ সব প্রকল্পে ১৫ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে, যা প্রস্তাবিত এডিপির ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এ ছাড়া এক হাজার ৪৫টি বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে। এর জন্য থাকছে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, একটি গতানুগতিক প্রক্রিয়া চলে আসছে এডিপিতে প্রচুর প্রকল্প থাকবে, তার অনেক প্রকল্পেই ছোট ছোট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ গতানুগতিক প্রক্রিয়ার সুফল অতীতে পাওয়া যায়নি। অবার অনেক প্রকল্পে বারাদ্দ পেলেও সময়মতো শেষ হয় না, গতি ধীর। এ সমস্যাগুলো সমাধান না করলে এডিপির বাস্তবায়নের গুণগত মান বাড়বে না। এতে একটা প্রকল্প শেষ হয়ে সম্পদ তৈরি হবে বা সেবা প্রদানের জায়গা তৈরি হবে, তা হবে না। গেল বছর নির্বাচনের বছরে তড়াহুড়া করে অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এগুলো পুনর্বিবেচনা করে পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত। এর মধ্যে সব প্রকল্প তৈরি আছে কিনা, সেগুলো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কিনা, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা বিবেচনায় নিয়ে এসব প্রকল্প এগিয়ে নেওয়া উচিত। পাশাপাশি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিয়ে এবং বাস্তবায়ন দুর্বলতা দূর করে সেগুলো দ্রুত শেষ করার পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ছোট আকারের বিপুল সংখ্যক প্রকল্প নিয়ে এডিপি প্রণয়ন করা হলে অর্থায়নে অনেক ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। প্রচলিত ধারায় রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রচুর প্রকল্প নেওয়া হয়ে থাকে। পরবর্তী সময় এ সব প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে এ সব প্রকল্পে অর্থও বরাদ্দ হয় না। এ অবস্থায় সুনির্দিষ্ট খাত চিহ্নিত করে বড় আকারের প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন তিনি।
এদিকে প্রস্তাবিত এডিপিতে চলমান প্রকল্পে বরাদ্দ থাকছে ১ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এডিপি প্রণয়ন নীতিমালায় নতুন প্রকল্প নিরুৎসাহিত করলেও এ খাতে ৮ হাজার ৩৯৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। থোক বরাদ্দের এ অর্থ থেকে নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে নতুন প্রকল্প অনুমোদন করা হবে। বিশেষ প্রয়োজনে উন্নয়ন সহায়তাবাবদ বরাদ্দ রয়েছে আরও ৯৬১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এ হিসাবে থোক আর উন্নয়ন সহায়তাবাবদ নতুন এডিপিতে বরাদ্দ থাকছে ৯ হাজার ৩৫৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
এডিপির প্রস্তাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া ফার্স্টট্রাকভুক্ত অন্যান্য প্রকল্পসহ বড় ১০ প্রকল্পে থাকছে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। মেগা এসব প্রকল্পে গুরুত্ব দিয়েই জাতীয় বাজেটের উন্নয়ন ব্যয় খাত বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা, পদ্মা সেতুতে ৫ হাজার ৩৭০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ৩ হাজার ৯৯৫ কোটি ২০ লাখ টাকা, মেট্রো রেলে ৭ হাজার ২১২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, কর্ণফুলী টানেলে ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৩ হাজার ৫৬ কোটি টাকা, পায়রা বন্দরের দুই প্রকল্পে ৭৬৫ কোটি টাকা, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পে ১ হাজার ১০৫ কোটি টাকা, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ৭০৫ কোটি টাকা, বঙ্গবন্ধু রেল সেতুতে ২ হাজার ২২৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
খাত হিসেবে আগামী বছর সর্বোচ্চ উন্নয়ন বরাদ্দ থাকছে পরিবহন খাতে। সড়ক, সেতু, রেল, নৌ ও বিমান মিলে এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৫২ হাজার ৮০৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। পদ্মা সেতু ও পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে এডিপির প্রায় ২৬ শতাংশ অর্থ।