মানুষের মনে তাকওয়া সৃষ্টি বা আল্লাহর ভয়ে সংযমী জীবনের অনুশীলনী হিসেবে আগমন করেছে মাহে রমজান। তাকওয়া অর্জনের প্রধান শর্ত হচ্ছে ‘ঈমান বিল গায়ব বা অদৃশ্যের ওপর বিশ্বাস স্থাপন। ‘গায়ব’ এর সরল অর্থ ‘যা দেখা যায় না, অদৃশ্য’। কিন্তু প্রকৃত অর্থে শুধু চর্ম চোখে না দেখার বস্তুকেই অদৃশ্য বস্তু বলে না। মানব দেহের পঞ্চেন্দ্রিয় যা অনুভব করতে পারে না এবং যুক্তি ও বুদ্ধির জোরে যা পুরোপুরি প্রমাণ করা যায় না, তাকেই ‘গায়ব’ বলা হয়। যেমন আল্লাহ্ তাআলার মহান সত্তা, কবরের জীবন, হাশরের ময়দান, বেহেস্ত-দোজখ, নেকি-বদির দাঁড়িপাল্লা, লাওহে মাহ্ফুজ প্রভৃতি। বস্তুবাদীরা অদৃশ্য বিশ্বাসের তাৎপর্য বুঝতে অক্ষম। তাদের অভিযোগ, ধর্ম মানে অন্ধ বিশ্বাস। তারা বলে, বিজ্ঞান ও যুক্তি অদৃশ্য বিশ্বাসকে বিশ্বাস করে না। এটি অন্ধ বিশ্বাসের নামান্তর। এ নিয়ে দীর্ঘ বিতর্কের অবকাশ আছে। আমরা সংক্ষেপে বলব, কেউ যদি কোনো বিরাট দালান বা বহুতল অট্টালিকা নির্মাণ করতে চায়, তাহলে প্রথমে মাটির নিচে অনেক গভীরে গিয়ে গাঁথুনি নির্মাণ করতে হবে। দালান-অট্টালিকা যত বিরাট ও আকাশচুম্বি হবে, এর গাঁথুনি বা পাইলিং তত
গভীর হবে। দালান নির্মাণের পর এ পাইলিং মানুষ দেখবে না, তা চোখের আড়ালে অদৃশ্যে থেকে যাবে। কোনো বস্তুবাদী যদি গৃহ নির্মাণের সময় এসে বলে, এত মাল-মসলা, লোহা-লক্কড়, ইট-পাথর মাটির নিচে পুঁতে রাখার কী দরকার; মানুষ তো ঘুমাবে মাটির ওপর। মাটির নিচে এত টাকা অপচয় করার কোনো মানে হয় না, তাহলে কেউ লোকটির মস্তিষ্ক সুস্থ আছে বলে বিশ্বাস করবে না।
মূলত অদৃশ্য বিশ্বাস বিজ্ঞানের প্রমাণ বা যুক্তি-বুদ্ধির পরিপন্থি কোনো বিষয় নয়। বিজ্ঞানের উন্নতির জন্যও এ বিশ্বাস অপরিহার্য। অদৃশ্যে বিশ্বাস না হলে মানব জীবনের কোনো উন্নতি-অগ্রগতিই সম্ভব নয়। বিজ্ঞানের যে কোনো পরীক্ষা শুরু হয় কোনো অনুমান বা অদৃশ্য বিষয় সামনে রেখে। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তা প্রকাশিত ও প্রমাণিত হয়। কাজেই বিজ্ঞান যদি অনুমান, কল্পনা, স্বপ্ন বা ‘মনে করি’ পরিভাষাগুলোকে স্বীকার না করেÑ যা অদৃশ্য, তাহলে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনুপ্রেরণা বা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না। মহাশূন্যে বিজ্ঞানীদের অভিযাত্রার পেছনে এ ধরনের অনুমানভিত্তিক ধারণাই প্রেরণাদায়দক ছিল। শুধু মানব জাতির উন্নতি-অগ্রগতিই নয়, মানুষের বংশ পরিচয়ও এ অদৃশ্য বিশ্বাস ছাড়া সম্ভব নয়।
আমরা বিশ্বাস করি, আমরা বাবার ঔরসে জন্মগ্রহণ করেছি। মায়ের কোলে লালিত পালিত হয়েছি। কিন্তু এ বিশ্বাসের পক্ষে আমাদের হাতে কী প্রমাণ আছে যে, যাকে মা বলে ডাকছি তিনিই আমার মা অথবা তিনি আর কারও কাছ থেকে আমাকে দত্তক গ্রহণ করেননি। জবাবে বলবেন, পাড়া-পড়শিরা বলেছেন, সাক্ষ্য দিচ্ছেনÑ এ সূত্রে তিনি আমার মা। তার অর্থ আমি নিজ চোখে না দেখলেও অন্যের কথায় একটি অদৃশ্য বিষয়কে বিশ্বাস করে সারা জীবন বলছি যে, ইনি আমার মা। আমি তার গর্ভ হতে জন্ম নিয়েছি। যদিও নিজ চোখে দেখিনি। আরও একটু অগ্রসর হলে, আমি যে একজনকে বাবা বলে ডাকছি, তার সন্তান বলে পরিচয় দিচ্ছি, তার কী প্রমাণ আমাদের হাতে আছে? বরং একমাত্র মায়ের সাক্ষ্যের ওপরই বাবার প্রতি বিশ্বাসের সৌধ নির্মিত।
এখন যদি নিজের বংশ পরিচয়ের ক্ষেত্রে পাড়া-পড়শির সাক্ষ্য বা মায়ের সাক্ষ্যকে পরম সত্য বলে বিশ্বাস করি; অথচ তাদের মিথ্যা বলার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকতে পারে, তাহলে মহাপুরুষ আল্লাহ্র নবী-রাসূলগণ (আ.)Ñ যারা সারা জীবনে কোনো মিথ্যার আশ্রয় নেননি, অদৃশ্য বিষয়াদি সম্পর্কে তাদের কথায় বিশ্বাস না আনার কী যুক্তি থাকতে পারে? তারা তো এ কথাই বলছেন যে, তোমাদের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, এ জীবনের পর আরেকটি জীবন তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
বস্তুত ইসলামের অদৃশ্য বিশ্বাস অন্ধবিশ্বাস নয়, বরং জীবনের বিশাল ইমারত গড়ে তোলার জন্য বিশ্বাসের নির্ভরযোগ্য পাইলিং অথবা অতীত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানের মহাসত্য আবিষ্কারের জন্য কোনো প্রাথমিক ধারণাকে অবলম্বন করার বৈজ্ঞানিক সূত্র, যা বিশাল সৃষ্টিজগতের সঙ্গে মানুষের ক্ষুদ্র অস্তিত্বকে যুক্ত করে।
রমজান এ বিশ্বাসই বদ্ধমূল করে প্রতিটি মুসলমানের মনে, মগজে ও আচরণে। এখন গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহ চলছে। ক্ষুধায় পিপাসায় খেটে খাওয়া মানুষের কলিজা শুকিয়ে কাট হয়ে যাওার অবস্থা। এ অবস্থায় একমাত্র সেই লোকই রোজা রাখতে পারেন, তিনি অদৃশ্যে বিশ্বাস করেন, মহান আল্লাহ তাআলাকে মনে-প্রাণে ভালোবাসে। সারা দিন রোজা রেখে সন্ধ্যায় ইফতারের পর শরীর বিছানায় এলিয়ে যায়; কিন্তু পরক্ষণে কোনো অদৃশ্য আহ্বানে রোজাদার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে হাজির হয় তারাবির নামাজের জন্য। শ্রান্ত, ক্লান্ত শরীরে রাতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে কুরআন খতম শোনার জন্য সময়ের কোরবানি যারা দেন, তাদের সম্পর্কে যে কেউ সাক্ষ্য দিতে পারেন, এরা অদৃশ্যে বিশ্বাস করেন। বেহেস্ত-দোজখের অস্তিত্ব তাদের কাছে আগামীকালের সূর্যোদয়ের মতো সত্য। মহামহিম আল্লাহর ভালোবাসায় তাদের মনপ্রাণ আপ্লুত, আমোদিত। তারাই শেষ রাতে হৃদয়ের কানে আল্লাহর আহ্বান শোনে জেগে উঠে শরিক হন সাহরির জেয়াফতে। হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা সাহরি খাও। কেননা, সাহরির মধ্যে বরকত নিহিত রয়েছে। (বুখারি, মুসলিম)