যশোরের কেশবপুরে আদর্শ বাড়ির রূপকার ফাতেমা বেগম। তিনি নিজের কর্ম প্রচেষ্টায় বাড়ির আঙিনায় গড়ে তুলেছেন গরুর খামার, বায়োগ্যাস প্লান্ট, হাঁস-মুরগির খামার, কেঁচো কম্পোষ্ট সার উৎপাদন ছাড়াও কৃষি অফিসের পরামর্শে বিষমুক্ত শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করে চলেছেন। সংসারের প্রয়োজন মিটিয়ে অবশিষ্ট বিক্রি করে তিনি এখন স্বাবলম্বী। তার অভাবনীয় সাফল্য এখন তাকে আরও বেশি উজ্জীবিত করেছে। একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি সরকারের মধ্যম আয়ের দেশ গঠনে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাফল্য দেখিয়ে চললেও তার ভাগ্যে জোটেনি সরকারের কোনো স্বীকৃতি।
ফাতেমা বেগমের বাড়ি উপজেলার প্রতাপপুর গ্রামে। তার স্বামী ফরিদ মোড়ল প্রতাপপুর নিভারানী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। তিনি জানান, তার স্বামীর সামান্য বেতনের টাকায় সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকত। ১৯৯০ সালের দিকে তিনি বর্তমান সরকারের একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে বসতভিটার কোনো জমি পতিত না রেখে কাজে লাগিয়ে আদর্শ বাড়ি গড়ার কাজে মনোনিবেশ করেন। মাত্র ৫০০ টাকা দিয়ে ৪টি হাঁস-মুরগি কিনে তার কার্যক্রম শুরু করেন। এ হাঁস-মুরগির ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করে তিনি তিলে তিলে হাঁস-মুরগির খামার গড়ে তোলেন। বর্তমানে তার খামারে ২৫০টি হাঁস ও মুরগি রয়েছে। মুরগি বিক্রির টাকায় তিনি একটি গাভী কিনে পরিকল্পনা নেন গরুর খামার করার। এছাড়া তিনি উপজেলা কৃষি বিভাগের পরামর্শে নিজের জমিতে বিষমুক্ত সবজিসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করে বাজারজাত করতে থাকেন। এরপর থেকে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমান তার খামারে ছয়টি গরু রয়েছে। কৃষি কাজ করতে গিয়ে তিনি উপলদ্ধি করেন স্বাস্থ্যসম্মত ফসল উৎপাদন করতে গেলে জৈব সারের বিকল্প নেই। এ সময় কৃষি অফিসের লোকজন তাকে কেঁচো কম্পোষ্ট সার (ভার্মি কম্পোষ্ট) তৈরিতে উৎসাহিত করতে থাকেন। কিন্তু সরাসরি গোবরে কেঁচো দিলে তা মরে যায়। এ জন্য তিনি পরিকল্পনা নেন বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট করার। এতে তার একদিকে যেমন রান্নার কাজে বায়োগ্যাস ব্যবহার করা যাবে অন্যদিকে এর অবশিষ্ট গোবর দিয়ে কেঁচো কম্পোষ্ট সার তৈরি করা যাবে।
২০১২ সালে তিনি বেসরকারি সংগঠন গ্রামীণ শক্তির কাছ থেকে ২৬ হাজার টাকা দিয়ে বাড়িতে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করেন। গরুর খামারের পাশে তিনি একটি নালা তৈরি করে তার ভেতর জৈব সার তৈরির কারখানা করার পরিকল্পনা করেন। ২০১৯ সালে তিনি বুটানিকা এগ্রো লিমিটেডের কাছ থেকে ৩০ হাজার থাই কেঁচো ১০ হাজার টাকা দিয়ে কিনে ওই কারখানার গোবরের মধ্যে ছেড়ে দেন। সপ্তাহ দুয়েক পর গোবর এক পাশ থেকে সরিয়ে দেখেন কেঁচোগুলোতে গোবর খেয়ে ছোট ছোট ফসফেটের দানার মতো পায়খানা করেছে। এগুলোই মূলত কেঁচো কম্পোষ্ট সার। সেই সঙ্গে কেঁচোগুলো বংশবিস্তারও ঘটিয়েছে। বর্তমানে তার বাড়িতে ৪টি চেম্বারে কেঁচো সার উৎপাদন হচ্ছে। এ খামারে তার প্রতি মাসে ৮ মণ গোবর লাগে। যা থেকে ৬ মণ কেঁচো সার উৎপাদিত হয়ে থাকে। তিনি প্রতি কেজি কেঁচো সার ১২ টাকা দরে বিক্রি করে থাকেন।
তার স্বামী জানান, বর্তমানে তার খামারের উৎপাদিত কেঁচো সার এলাকার কৃষকরা নিচ্ছেন। কিন্তু এরপরও অবশিষ্ট থেকে যাচ্ছে। তিনি মার্কেটিংয়ের সুযোগ পেলে একদিকে যেমন সারের উৎপাদন বৃদ্ধি পেত অন্যদিকে কৃষি জমি বাঁচত। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে জানান, ৪ মাস আগে তার খামারের উৎপাদিত কেঁচো সারের নমুনা পরীক্ষার জন্য উপজেলা কৃষি অফিসে জমা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি অদ্যাবধি লাইসেন্স পাননি। তার স্ত্রীর এ কাজের সফলতা দেখে অনেকেই এসব পেশায় আকৃষ্ট হয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছেন।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মহাদেব চন্দ্র সানা জানান, মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখাসহ বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করতে হলে কেঁচো সারের বিকল্প নেই। ফাতেমা ভালো উদ্যোগ নিয়েছেন। অচিরেই খামারটি পরিদর্শন করে লাইসেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।