আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ২৪-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

অনন্য ফজিলতের ইতেকাফ

মাহবুবুর রহমান নোমানি
| ইসলাম ও সমাজ

পবিত্র মাহে রমজানের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল ইতেকাফ করা। রমজানের শেষ দশকে মসজিদে ইতেকাফ করা সুন্নতে মোয়াক্কাদা। রাসুলুল্লাহ (সা.) সারাজীবন এই মহৎ আমলটি করে গেছেন। তাই ইমাম জুহরি (রহ.) বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, ‘অনেক আমল তো নবীজি কখনও করেছেন, কখনও ছেড়েছেন। কিন্তু ইতেকাফের আমলটি তিনি কখনোই ছেড়ে দেননি। অথচ এই মর্যাদাপূর্ণ আমলটির ব্যাপারে মানুষ তেমন গুরুত্ব দেয় না।’ ইতেকাফ  আল্লাহর নৈকট্য লাভের সহজ উপায়। তাঁর সঙ্গে সুনিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যম। কারণ, মানুষ যখন সংসার জগতের কর্মকা- থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে আল্লাহর ঘরে ইবাদতের নিমিত্তে আত্মনিয়োগ করবে, তখন দয়াবান স্রষ্টা কি তার থেকে বিমুখ থাকতে পারেন? তিনি তো ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, ‘বান্দা আমার দিকে একহাত অগ্রসর হলে আমি তার দিকে দুইহাত অগ্রসর হই। আমার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।’ আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রয়েছে, ‘কেউ যখন আল্লাহর ঘর মসজিদে অবস্থান নেয় তখন আল্লাহ তায়ালা এত বেশি আনন্দিত হন যেমন বিদেশ-বিভুঁই থেকে কেউ বাড়িতে এলে আপনজনরা আনন্দিত হয়ে থাকে।’ (তারগিব-তারহিব : ৩২২)।

ইতেকাফের অনন্য ফজিলত
ইতেকাফের ফজিলত ও বৈশিষ্ট্য অপরিসীম। এর কল্যাণ ও উপকারিতা বর্ণনাতীত। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘ইতেকাফকারী যাবতীয় গোনাহ থেকে মুক্ত থাকে এবং তার জন্য ওই পরিমাণ নেকি লেখা হয় যা আমলকারীর জন্য লেখা হয়।’ (ইবনে মাজাহ)। হাদিস থেকে বোঝা যায়, ইতেকাফকারী ব্যক্তি ঘুমন্ত-জাগ্রত সর্বাবস্থায় ইবাদতকারী হিসেবে গণ্য হয়। আল্লাহর ঘর মসজিদে অবস্থান করার কারণে তার দ্বারা পাপকর্মও সংঘটিত হয় না। বরং মানবশত্রু শয়তানের আক্রমণ থেকে সে বেঁচে যায়। অন্য একটি হাদিসে রয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন ইতেকাফ করে আল্লাহ তায়ালা তাকে জাহান্নাম থেকে তিন খন্দক দূরে সরিয়ে দেন। প্রত্যেক খন্দকের পরিমাণ আসমান ও জমিনের দূরত্ব সমান।’ (তাবরানি ও বায়হাকি)। এ হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয়, ইতেকাফকারী ব্যক্তি পরকালে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে। ইতেকাফের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর মাগফিরাতের বারি দ্বারা সিক্ত হয়। কারণ, ইতেকাফকারীর দৃষ্টান্ত প্রিয়তমের দরবারে প্রেমিকের আশ্রয় গ্রহণ কিংবা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কারও বাড়িতে অনশনকরণ। এরকম অবস্থানের ফলে পাষাণ ব্যক্তির হৃদয়ও বিগলিত হয়। অন্তরে উথলে ওঠে দয়া-মায়ার ঢেউ। তাহলে অসীম দয়ালু আল্লাহর ঘরে অবস্থান করে কেউ কি বঞ্চিত হবে? হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে নিজ ঘর থেকে উত্তমরূপে অজু করে মসজিদে আসে সে আল্লাহর মেহমান। আর মেহমানকে সম্মান করা মেজবানের দায়িত্ব।’ (তাবরানি, কাবির)। ইতেকাফের একটি বড় দিক হচ্ছে এর ফলে শবেকদর পাওয়া অনেকটা নিশ্চিত। কারণ, শবেকদর রমজানের শেষ দশকে রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) মূলত শবেকদরের অন্বেষণেই ইতেকাফ করতেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে রয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি শবেকদরের উদ্দেশ্যে রমজানের প্রথম দশকে ইতেকাফ করেছিলাম। দ্বিতীয় দশকেও একই উদ্দেশ্যে ইতেকাফ করেছি। কিন্তু আমাকে জানানো হয় তা শেষ দশকে। অতএব, যারা আমার সঙ্গে ইতেকাফ করেছ তারা যেন শেষ দশকেও ইতেকাফ করে।’ (বোখারি ও মুসলিম)। 

ইতেকাফের শর্ত
১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা হয় এমন মসজিদে ইতেকাফ করা আবশ্যক। তবে মহিলারা ঘরে একটি স্থান নির্ধারণ করে ইতেকাফ করবে। 
২. ইতেকাফের জন্য নিয়ত অপরিহার্য। নিয়ত ব্যতীত মসজিদে অবস্থান করলে ইতেকাফ হিসেবে গণ্য হবে না।  
৩. ওয়াজিব এবং সুন্নত ইতেকাফের জন্য রোজা রাখা জরুরি। তবে নফল ইতেকাফের জন্য রোজা জরুরি নয়। 
৪. মহিলাদের ইতেকাফের জন্য হায়েজ-নেফাজ থেকে মুক্ত হওয়া আবশ্যক। 
৫. ইতেকাফের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া শর্ত নয়। অপ্রাপ্ত বুঝমান ছেলেরা ইতেকাফ করতে পারবে। তবে তাদের ইতেকাফ হবে নফল।   

ইতেকাফে করণীয়-বর্জনীয়
শরয়ি বা তাবয়ি (প্রাকৃতিক) প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হলে ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। এমনিভাবে অজু বা ইস্তিঞ্জা করতে গিয়ে অযথা সময়ক্ষেপণ করা যাবে না। গোসল ফরজ না হলে গোসল করার জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই। ইতেকাফ অবস্থায় বেহুদা কথাবার্তা, গিবত-পরনিন্দা, ঝগড়া-বিবাদ, মসজিদে উচ্চ স্বরে কথা বলা বা হৈচৈ করা সম্পূর্ণ নিষেধ। আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) লেখেন, ‘ইতেকাফের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মহামহিম আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা। হৃদয়-মনে একমাত্র তাঁর ধ্যান-খেয়াল জাগরুক রাখা। পার্থিব জগতের সব কিছুর মায়াজাল ছিন্ন করে একমাত্র আল্লাহর মহব্বতে ডুবে থাকা।’ 
সুতরাং ইতেকাফকারী চুপচাপ বসে না থেকে কোনো না কোনো ইবাদতে মগ্ন থাকবেন। বিশুদ্ধভাবে কোরআন পড়তে পারলে বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করবেন। নফল নামাজ, দরুদ শরিফ, ইস্তিগফার ও কালেমার জিকিরের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দেবেন। ইশরাক, চাশত, আওয়াবিন ও তাহাজ্জুদ নামাজের প্রতি যতœশীল হবেন। বিজোড় রাতগুলো শবেকদরের তালাশে অধিক পরিমাণে ইবাদত করবেন। দোয়া ও মোনাজাতে কান্নার চেষ্টা করবেন।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া উসমানিয়া দারুল উলুম সাতাইশ, টঙ্গী