রমজানের প্রতি রাতে মহান প্রভুর পক্ষ থেকে কল্যাণের ঘোষক ঘোষণা করতে থাকেন : ‘হে কল্যাণ-সন্ধানী অগ্রসর হও আর হে অকল্যাণ-সন্ধানী নিবৃত্ত হও।’ এটি পুনরাবৃত্তিমূলক উপদেশ। সার্বক্ষণিক স্মারক। নিয়মিত আহ্বান। এটি মোমিনদের পথ দেখায় কল্যাণ সম্পাদন এবং তাদের জন্য কল্যাণকর কাজে অগ্রসর হতে। বিরত রাখে অকল্যাণ এবং যাতে তাদের ক্ষতি এমনসব বিষয় থেকে। কেন নয়, মুসলিমের কাছে কাম্য তো শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার ও পাথেয় সংগ্রহ করা। ‘হে মোমিনরা! তোমরা রুকু কর, সিজদা কর, তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত কর এবং সৎকাজ সম্পাদন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’ (সূরা হজ : ৭৭)।
অতএব আমাদের জন্য কতই না গুরুত্বপূর্ণ এ গুটিকয়েক দিনগুলোতে আমাদের রবের রহমতে সিক্ত হওয়া। তাঁর দানের জোয়ার ও অনুগ্রহের ব্যাপক বর্ষণে প্লাবিত হওয়া। নিম্নে এ মহান মৌসুমে কল্যাণকর্ম সম্পাদনে কিছু নিয়ম, পয়েন্ট ও পরামর্শ তুলে ধরা হলোÑ
প্রথম : আপনার সার্বক্ষণিক অভীষ্ট ও ব্যস্ততা যেন হয় কল্যাণ অর্জন। সেটা এভাবেÑ সর্বদা কল্যাণের নিয়ত রাখবেন এবং তা সম্পাদনে সচেষ্ট থাকবেন। যদি আল্লাহ আপনাকে তা সম্পাদনের তাওফিক দেন এবং তা বাস্তবায়নে সাহায্য করেন; তবে আপনি যাতে আগ্রহী এবং যাতে সচেষ্ট তার প্রতিদান অর্জিত হয়ে গেল। আর যদি তা না করতে পারেন এবং নিয়ত ও কর্মের মাঝে অন্তরায় তৈরি হয়, তাহলেও যার নিয়ত করেছেন তার সওয়াব অবধারিত।
আবদুল্লাহ বিন ইমাম আহমদ বিন হাম্বল একদিন তার পিতার উদ্দেশে বললেন, হে পিতা, আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন, ‘হে আমার পুত্র, কল্যাণের নিয়ত করো। কেননা তুমি ততক্ষণই কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যতক্ষণ কল্যাণের নিয়ত রাখবে।’
এ এক মহান উপদেশ। এর বাস্তবায়নকারীর নেকি সদা চলমান থাকে। কারণ তার নিয়ত বহাল ও চলমান থাকে। অতএব বান্দা যখন তার সংকল্পকে সুন্দর করে আর তার উপকরণ প্রস্তুত না থাকে, তাহলেও তাকে শুধু নিয়তের দরুন পূর্ণ নেকি প্রদান করা হয়। আর যদি নিয়ত ও সংকল্পের পর সেটি করেও ফেলে, তখন আল্লাহ তার জন্য দশটি নেকি লিখে দেন। বরং দশ থেকে সাতশ গুণ এবং সাতশ থেকে বহু গুণ বৃদ্ধি করেন। মহাসত্যবাদী ও মহাসত্যায়িত নবী (সা.) আমাদের যা জানিয়েছেন তার সারাংশ এমনই।
পক্ষান্তরে মানুষের কর্তব্য, যে পাপ ও অপরাধ ঘটে গেছে তার জন্য সদা অনুতাপ ও আফসোস করা। এটিই তাকে ভবিষ্যতে পাপাচার থেকে রুখতে যথেষ্ট।
দ্বিতীয় : সদা বিশ্বাস রাখবেনÑ কল্যাণকর্মই কেয়ামতের দিন মানুষের উপকারে আসার মতো প্রকৃত পাথেয়। এটিই থাকবে ও সঞ্চিত হবে। কম-বেশি যাই হোক তা বরবাদ হবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা যেসব সৎকাজ করবে, কোনো অবস্থাতেই সেগুলোর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হবে না।’ (সূরা আলে ইমরান : ১১৫)।
অতএব কল্যাণকর্মের মাধ্যমে পাথেয় সংগ্রহ করুন। সুযোগ কাজে লাগান। কোনো আমলকেই তুচ্ছ মনে করবেন না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা নিজেদের জন্যে যা কিছু অগ্রে পাঠাবে, তা আল্লাহর কাছে উত্তম আকারে এবং পুরস্কার হিসেবে বর্ধিতরূপে পাবে।’ (সূরা মুজ্জাম্মিল : ২০)। আল্লাহর বাণী : ‘অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তা-ও দেখতে পাবে।’ (সূরা জালজালাহ : ৭-৮)Ñ এর ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘দুনিয়ায় মোমিন-কাফের নির্বিশেষে ভালো-মন্দ যে আমলই করুক না কেন আল্লাহ তায়ালা তা (কেয়ামতের দিন) তাকে দেখাবেন। মোমিন ব্যক্তি তার পুণ্য ও পাপ সবই দেখতে পাবে। আল্লাহ তার পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন আর পুণ্যগুলোর বিনিময় দান করবেন। পক্ষান্তরে কাফেরও তার ভালো-মন্দ দেখতে পাবে। কিন্তু তার ভালোগুলো প্রত্যাখ্যান করা হবে এবং মন্দগুলোর কারণে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে।’
তৃতীয় : এ পৃথিবীতে বিশেষত এই মোবারক মৌসুমে কল্যাণীদের সঙ্গী হোন। কারণ সঙ্গী ও বন্ধু হিসেবে তারাই শ্রেয়। হাতেম আসাম (রহ.) বলেন, ‘আমি লক্ষ করেছি, সব মানুষেরই বন্ধু থাকে। যার সঙ্গে নিজের গোপন বিষয় ভাগাভাগি করে। যাকে নিজের কষ্টের কথা জানায়। তাই আমি নির্বাচন করেছি নিজের জন্য উত্তম সঙ্গী। যাতে সে হিসাবের দিন আমার সঙ্গে থাকে। পুলসিরাত পার হয় আমার সঙ্গে।’
চতুর্থ : কল্যাণের চাবি আর অকল্যাণের তালা হোন। মহানবী (সা.) এর ভাষ্য মতে, মানুষ দুই প্রকার : ‘নিশ্চয়ই কতক লোক আছে, যারা কল্যাণের চাবিকাঠি এবং অকল্যাণের দ্বার রুদ্ধকারী। পক্ষান্তরে এমন কতক লোক আছে, যারা অকল্যাণের দ্বার উন্মুক্তকারী এবং কল্যাণের দ্বার রুদ্ধকারী। সেই লোকের জন্য সুসংবাদ, যার দুই হাতে আল্লাহ কল্যাণের চাবি রেখেছেন। আর সেই লোকের জন্য ধ্বংস, যার দুই হাতে আল্লাহ অকল্যাণের চাবি রেখেছেন।’
বান্দার ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্যতম নিদর্শন এ কল্যাণের চাবি হতে পারা। যদি তাকে দেখানো হয়; তবে তাকে দেখে আল্লাহর স্মরণ করা হয়। সে নিরন্তর কল্যাণের মধ্যেই আবর্তিত হয়। কল্যাণ সাধন করে; কল্যাণের কথা বলে; কল্যাণ নিয়ে চিন্তা করে এবং কল্যাণের কথা হৃদয়ে পোষণ করে। ফলে সে যেখানেই হাজির হয়, কল্যাণের চাবি ও সূচনাকারী হয়ে যায়। যেই তার সঙ্গী হয়, সে তার কল্যাণের উপলক্ষ হয়। পক্ষান্তরে কেউ কেউ অকল্যাণের মধ্যে আবর্তিত হয়। অকল্যাণকর কাজ করে; অকল্যাণের কথা বলে; অকল্যাণজনক বিষয় চিন্তা করে এবং অহীতকর ভাবনা হৃদয় পোষণ করে। ফলে সে হয় সমূহ অকল্যাণের চাবি-উন্মোচক।
পাশাপাশি জেনে রাখুন, বান্দার ঈমান পূর্ণই হয় না যতক্ষণ সে অপর মুসলিম ভাইয়ের জন্য কল্যাণের আশা না করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ প্রকৃত মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য সেটাই পছন্দ করবে, যা তার নিজের জন্য পছন্দ করে।’
পঞ্চম : এটা কত বড় ব্যাপারÑ মোমিন ব্যক্তি কল্যাণের পথ প্রদর্শক হবে। যাতে সে পূর্ণ প্রতিদান পায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো কল্যাণের পথ প্রদর্শন করবে সে ততটা সওয়াব লাভ করবে, যতটা কাজটি সম্পাদনকারী পাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কল্যাণের পথ প্রদর্শক তা সম্পাদনকারীর মতো।’
আর মানুষ অপরের জন্য যা করে তার মধ্যে সবচেয়ে উপকারী হলো তাদের পথ দেখানো, শিক্ষা দেওয়া, উপদেশ দেওয়া, কল্যাণ সম্পাদনে পথ দেখানো, সময় কাজে লাগাতে উদ্বুদ্ধ করা এবং নেকির সুযোগ কাজে লাগাতে উদ্বুদ্ধ করা।
ষষ্ঠ : আল্লাহর কাছে দ্বীনের ওপর অবিচলতা কামনা করুন। তাঁর কাছে প্রার্থনা করুন তিনি যেন আপনাকে তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন, যারা তাঁর আনুগত্য ও তাকওয়া আঁকড়ে ধরে। তাঁর কাছে আশ্রয় চান যেন তিনি আপনাকে উল্টো পথে নিক্ষেপ না করেন। যার ফলে আপনি কল্যাণ ছেড়ে দেন এবং তা থেকে সরে আসেন। অকল্যাণ করেন আর আপনার হৃদয় অকল্যাণে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘কোনো ব্যক্তিকে নিরাপদ ভেব না এ থেকে যে, সে কল্যাণের পথে ছিল আর তা থেকে অকল্যাণে ফিরে এলো। অবশেষে অকল্যাণের ওপরই তার মৃত্যু হলো। তেমনি কোনো ব্যক্তির ব্যাপারে নিরাশ হয়ো না যে, সে মন্দের ওপর ছিল আর তা থেকে মঙ্গলের পথে এলো। অতঃপর মঙ্গলের ওপরই মৃত্যুবরণ করল।’
সপ্তম : আল্লাহর এই বাণীটি নিয়ে ভাবুন : ‘আর তোমরা যা কিছু সৎকাজ কর, আল্লাহ তো জানেন।’ এটি বান্দার হৃদয়ে প্রশান্তি সঞ্চার করে। তার অন্তরে তৃপ্তি দেয়। কেননা মানুষের প্রতি সদাচারকারী যিনি ইখলাসের সঙ্গে করছেন, তিনি মানুষের সম্মান বা প্রশংসার অপেক্ষা করেন না। তিনি যখনই কল্যাণ সাধন করেন, বিশ্বাস রাখেন যে তার রব তা জানছেন এবং তিনি এর প্রতিদান অবশ্যই দেবেন। এতে করে তার ভালো ও মঙ্গল কর্মের বিপরীতে অকৃতজ্ঞতা ও অস্বীকৃতি সহ্য করা সহজ হয়ে যায়। বরং সে আল্লাহর এই বাণী অনুভবে রাখে : ‘তারা বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদের আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।’ (সূরা ইনসান : ৯)।
১২ রমজান ১৪৪০ হিজরি মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত
ভাষান্তর আলী হাসান তৈয়ব