- বছরে ধান উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৫০ লাখ টন
- সরকার সংগ্রহ করে মাত্র ১০ থেকে ১২ লাখ টন
উৎপাদিত ধান বিক্রি করে কৃষক তার পরিবারের জন্য বছরের খরচ জোগান দেবেন এমন প্রত্যাশা থাকতেই পারে। কিন্তু কৃষকের এমন প্রত্যাশা এখন শুধুই হতাশায় রূপ নিয়েছে। ধান বিক্রি করে খরচ দিয়ে পরিবার চালানো তো দূরে থাক উৎপাদন খরচ ওঠানো নিয়েই ভাবতে হচ্ছে। যেন সব বঞ্চনা কৃষকের। আর তাদের উৎপাদিত ফসলে মুনাফার হিসাব করছেন ফড়িয়ারা।
এরই মধ্যে সারা দেশে সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ শুরু হয়েছে। এ বছর প্রতি মণ ধান কেনা হচ্ছে ১ হাজার ৪০ টাকায়। কিন্তু এরই মধ্যে অনেক কৃষক তাদের উৎপাদিত ধান বিক্রি করেছেন ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকায়। ফলে সরকারের এমন উদ্যোগে খুব বেশি ভাগ্য বদল হয়নি কৃষকের। এছাড়া কৃষকের কাছে যে ধান আছে তার ১০ ভাগের এক ভাগও নিচ্ছে না সরকার।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা হলে তা সংরক্ষণের জন্য গুদামের যে পরিমাণ ধারণক্ষমতা প্রয়োজন, তা নেই। বরং গুদামের ধারণক্ষমতা বাড়ানো গেলে কৃষকের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে ধান কেনা সম্ভব হবে। জানা গেছে, কুষ্টিয়াতে এবার ধানের বাম্পান ফলন হয়েছে। সরকারিভাবে ধান কেনা শুরু হলেও তাতে হতাশ কৃষক। সরকার এ বছর কুষ্টিয়া থেকে ১ হাজার ২৪ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করবে, যেখানে পুরো জেলায় ধানের উৎপাদন হয়েছে প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে ধান উৎপাদন হয়েছে ৯৯ হাজার মেট্রিক টন, সেখানে সরকার কিনবে মাত্র ২২৫ মেট্রিক টন।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের কৃষি খাত। তবু সরকারের নানারকম উদ্যোগের ফলে দেশে এখন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ধান উৎপাদন হচ্ছে। ধানের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে গেলেও এই মুহূর্তে কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে দাম বাড়ানোর তেমন সুযোগ নেই। এছাড়া সারা দেশ থেকে চাষিদের নির্বাচন করা কঠিন বলেই সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান বা চাল কেনা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, বছরে ধান উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৫০ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সরকার সংগ্রহ করে ১০ থেকে ১২ লাখ টন। এগুলো গুদামে সংরক্ষণ করা হয়। এর সঙ্গে আছে অন্যান্য খাদ্যপণ্য। গুদামের ধারণক্ষমতা কম হওয়ায় বেশি ধান সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না।
২০১৮ সালের এক হিসাবে জানা গেছে, বর্তমানে সরকারি গোডাউন ও সাইলোতে খাদ্যশস্যের মোট ধারণক্ষমতা আছে প্রায় ২১ লাখ মেট্রিক টন। ২০১৮ সালের শেষে ধারণক্ষমতা দাঁড়ানোর কথা ২২ লাখ মেট্রিক টনের কাছাকাছি। এছাড়া ২০২০ সাল নাগাদ ধারণক্ষমতা বেড়ে প্রায় ২৭ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন এবং ২০২৫ সাল নাগাদ ধারণক্ষমতা প্রায় ৩০ লাখ মেট্রিক টন হবে। খাদ্য বিভাগের সূত্র জানা গেছে, কৃষক ধান বিক্রি করলেই যে সরকারের কাছ বিক্রীত টাকা পাবেন তা নয়। এজন্য প্রয়োজন হবে কৃষকের নাম, কৃষক পরিচয়পত্র, স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রত্যয়নকৃত জমির খতিয়ান নম্বর, জমির আয়তনের ভিত্তিতে উৎপাদনের পরিমাণ-এসব তথ্যাদির ভিত্তিতে অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকের মাধ্যমে পাওনা পাবেন কৃষক। চেক প্রদানের আগে সব কিছু যাচাই করবেন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক। কৃষকের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংগঠনগুলো বলছেন, এসব শর্ত মূলত করা হয়েছে বড় ফড়িয়াদের জন্য। সাধারণ কৃষকের পক্ষে এসব শর্ত মেনে ধান বিক্রি করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির যুগ্ম সম্পাদক কামরুল হক লিকু আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সরকার যে সময়ে ধান কেনা শুরু করেছে সেই সময়ে অনেক কৃষক তাদের ধান কম মূল্যে বিক্রি করে দিয়েছে। মূলত বর্তমানে দেশে ধান চাষ করে ভূমিহীন কৃষক। যারা ধান বিক্রি করে মহাজনদের ঋণ পরিশোধ করে, আর সেই ধান ফড়িয়ারা কিনে এখন সরকারের কাছে বেশি দামে বিক্রি করছেন। ধান উৎপাদনে যে কৃষক সারা সময় কষ্ট করলেন সে কিছুই পেলেন না।
তিনি বলেন, আমাদের সংগঠনের মাধ্যমে বলতে চাচ্ছি ধান উৎপাদন খরচ এখন অনেক বেশি। এটি কমিয়ে আনতে হবে। উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব হলে ধানের ন্যায্যমূল্য পাবেন কৃষক। এছাড়া সরকারের কাছে যেসব কৃষক ধান বিক্রি করেন তাদের ব্যাংক হিসাব, জাতীয় পরিচয়পত্র থাকা বাধ্যতামূলক। একই সঙ্গে ধান বিক্রির টাকা উত্তোলনের সময়ও কিছু শর্ত দেওয়া হয়। এগুলো মূলত করা হয় ফড়িয়াদের স্বার্থ বিবেচনা করে। সাধারণ কৃষকের পক্ষে এসব শর্ত পরিপালন করে সরকারের কাছে বেশি দামে ধান বিক্রি করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি এর সুফলও তারা পান না।
তিনি বলেন, এছাড়া সরকার ধান কেনার জন্য যে জায়গা নির্ধারণ করে সেটিও কৃষকের বসতবাড়ি বা বাজার থেকে অনেক দূরে। কৃষকের পক্ষে ধান নিয়ে সেসব জায়গায় যাওয়াও অনেক সময় সম্ভব হয় না। ফলে সরকারের ধান বিক্রির কেন্দ্র মোকাম বা বাজারের মধ্যে রাখা উচিত। তাহলে কৃষক সহসা তাদের ধান বিক্রি করতে নিয়ে যেতে পারবেন।