একটি বালিশের দাম এত? শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেত! বর্তমান সময়ে একটা বালিশ বিক্রির টাকায়ও প্রায় ১১ মণ ধান পাওয়া যাবে! রূপপুরে ‘বালিশ-কেটলির’ উপাখ্যান পুরো প্রকল্পে সম্ভাব্য অনিয়মের ‘হিমশৈলের চূড়া’ মাত্র নয়তো! সমুদ্রে ভেসে থাকা হিমশৈলের মাত্র ১০ শতাংশ পানির উপরে দৃশ্যমান থাকে। যেমনিভাবে যে কোনো কোল্ডড্রিংসে বরফের টুকরো দিলে খুব অল্প একটু ভেসে থাকে, বাকিটা ডুবে থাকে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। সেখানে মাত্র ২৫ কোটি টাকা খরচের ক্ষেত্রেই যে ভয়াবহ অনিয়মের চিত্র দেখা যাচ্ছে, তাতে শঙ্কিত হতেই হয়! ব্যয়ের দিক থেকে এটিই হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রকল্প, যা পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রায় ৪ গুণ। সমাজবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, ‘ছোট ছোট দুর্নীতি থেকেই বড় বড় দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়।’ সে হিসেবে শুরুতেই যে অনিয়মের দৃশ্য এসেছে, তা ভেসে থাকা ‘হিমশৈলের চূড়া’ কী? তাহলে পানির নিচে বিশাল লুকোনো অংশটিতে কী রয়েছে? বিষয়টি যাদের দেখার এবং বোঝার তাদের বুঝতে হবে, বালিশ-কেটলির খবরটা ‘ঘুম থেকে জেগে ওঠার ডাক’ মাত্র! এরপরও সংশ্লিষ্টরা যদি জেগে জেগে ঘুমান, তাকে কে জাগাবে?
আমাদের নৈতিক চরিত্রের এতটাই অবক্ষয় হয়েছে যে, দুর্নীতিতে আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা অন্ধ হয়ে গেছেন! তারা রাতকে দিন বানাচ্ছেন আর দিনকে রাত! না হলে একটি বালিশ কিনতে তাদের ৬ হাজার টাকা খরচ করতে হবে! যে যেখানে পারছে লুটে নিচ্ছে। সবাই যেন ধরে নিয়েছে সরকারি তহবিল তছরুপ করলে কিছু হয় না।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে কেনাকাটা নিয়ে যা ঘটেছে, তা অকল্পনীয় সমুদ্রচুরির ঘটনা! বাংলাদেশে নজিরবিহীন বহু ঘটনাই রয়েছে; কিন্তু দুর্নীতির কোনো ঘটনা, মহা থেকে ‘মহা-নজিরবিহীন’ হতে পারে কি না, এ নিয়ে গোলবাধা এখন আর স্বাভাবিক ব্যাপার নয়! ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় যেখানে বালিশ কেনা যায়, সেখানে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকায় বালিশ কিনে তা আবার ২০ তলার একটি ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে ৭৬০ টাকা ব্যয়ের ঘটনা সবচেয়ে বেশি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। অনেকেই এ ঘটনাকে ‘রূপকথার গল্পের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। অতীতেও বাংলাদেশে দুর্নীতির যে সামগ্রিক চিত্র বেরিয়ে এসেছে, তা এককথায় ভয়াবহ। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে উন্নয়নের প্রধান এবং একমাত্র অন্তরায় দুর্নীতি। আর এ দুর্নীতির অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র সরকারি ‘সুশিক্ষিত’ প্রশাসন। অশিক্ষিত লোকের চেয়ে শিক্ষিত লোকেরাই দেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে! রূপপুর তার একটা উদাহরণ মাত্র! এ সমাজ একজন পেটের দায়ে চোরকে যতটা অবজ্ঞা করে, তার কিছুমাত্র যদি এ ‘শিক্ষিত’ চোরদের করত; তবে দেশে চুরিচামারি অনেক কমে আসত!
বাংলাদেশের দুর্নীতির গল্প ঠিক আরব্য রজনির গল্পের মতো! রাত ফুরিয়ে ভোর হবে; কিন্তু সীমাহীন দুর্নীতির গল্প যেন শেষ হওয়ার নয়! সম্প্রতি রূপপুর গ্রিনসিটি প্রকল্পের কেনাকাটায় যে দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে এসেছে, তা তো রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। প্রকল্পের প্রারম্ভেই অতি সাধারণ কেনাকাটায় এত বেশি দুর্নীতি চিত্র যে, কেনাকাটার তালিকাটির প্রতি কারও নজর পড়লে সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছেন।
এই প্রকল্পটা বাংলাদেশের এ পর্যন্ত সব প্রকল্পের চেয়ে বেশি গুরুত্বসহকারে ও কঠোর তত্ত্বাবধানে করার কথা। কারণ সামান্য দুর্ঘটনা পুরো দেশটাকে বিপদে ফেলতে পারে। এর আগে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা রাশিয়ায় চেরনোবিল হয়েছে, জাপানে ফুকুশিমার দাইচিতে হয়েছে, আমেরিকায় থ্রি মাইল আইল্যান্ডে হয়েছে। কাজেই এটার নিরাপত্তার ব্যাপারটিতেই গুরুত্ব দিতে হবে সবচেয়ে বেশি। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে ঢিলেঢালা ব্যবস্থাপনায় তৈরি হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া, এর বাস্তবায়নের দায়িত্বও তাদের হাতে। আর আন্তর্জাতিক পরিম-লে রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি এবং সে দেশের সরকার ও সরকারের যোগসাজশপুষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ধার ধারে না। তাই এ প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য এখন থেকেই সর্বোচ্চ সচেষ্টতা জরুরি নয় কি?
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ছয় দশকের প্রত্যাশিত একটি স্বাপ্নিক প্রকল্প। বিগত শতকের ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এ বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করলেও স্বাধীনতার পর প্রায় অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো সরকারই এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সাহসী উদ্যোগের মধ্য দিয়ে জাতির সুদীর্ঘদিনের প্রত্যাশার বাস্তবায়ন ঘটতে চলেছে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ প্রকল্প নিয়ে নানামুখী বিতর্ক থাকার পরও তা সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। যদিও পৃথিবী থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আস্তে আস্তে কমিয়ে ফেলা হচ্ছে, বহু দেশ এখান থেকে সরে আসছে নিরাপত্তার ঝুঁকির কারণে। কিন্তু বাংলাদেশে শুরুতেই সাধারণ একটি অংশে যে ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, তাকে এ প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ভবিষ্যতের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে মনে করতে হবে।
অন্যান্য মেগা প্রকল্পের মতো এ প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই অস্বাভাবিক উচ্চব্যয় ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে দেখা গেছে। এখন রূপপুর আবাসন প্রকল্পে যেসব দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও অস্বাভাবিক ব্যয়ের তথ্য উঠে এসেছে, তাতে মূল প্রকল্পের ব্যয় নিয়েও জনমনে সন্দেহ ও সংশয় দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক। উপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে গ্রিনসিটি প্রকল্পে দুর্নীতি-অস্বচ্ছতার সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরা এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার মাধ্যমে সে সংশয় দূর করতে হবে।
সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি-অপচয় ও অস্বচ্ছতার দরজা খোলা থাকা কোনো নতুন বিষয় নয়। বিভিন্ন সেক্টরে বছরের পর বছর ধরে অনিয়ম-দুর্নীতি অব্যাহত আছে। প্রকল্পের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের থাকার জন্য ২০তলা আটটি ও ১৬তলা একটি ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য একটি বৈদ্যুতিক চুলার দাম ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৭৪৭ টাকা এবং তা ভবনে তুলতে খরচ ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৬৫০ টাকা। একটি বৈদ্যুতিক কেটলির দাম ৫ হাজার ৩১৩ টাকা, ওঠানোর খরচ ২ হাজার ৯৪৫ টাকা। প্রতিটি ইলেকট্রিক আয়রন কিনতে খরচ পড়েছে ৪ হাজার ১৫৪ টাকা, ওঠানোর খরচ ২ হাজার ৯৪৫ টাকা। ফ্রিজের দাম দেখানো হয়েছে ৯৪ হাজার ২৫০ টাকা, ওঠানোর খরচ ১২ হাজার ৫২১ টাকা। মাইক্রোওয়েভ প্রতিটি ৩৮ হাজার ২৭৪ টাকা, ওঠানোর খরচ ৬ হাজার ৮৪০ টাকা। প্রতিটি সোফা কেনা হয়েছে ৭৪ হাজার ৫০৯ টাকায়, ওঠানোর খরচ ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ২৪৪ টাকা করে।
এভাবে বিভিন্ন পণ্য ক্রয় ও তা ভবনে তুলতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। সরকারি টাকার এ রেকর্ড লুটপাটে নাম এসেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের আওতায় মূল প্রকল্প এলাকার বাইরে গ্রিনসিটি আবাসন পল্লির।
এ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের মাসিক বেতন ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। পাশাপাশি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করবেন; এজন্য আরও ২ লাখ টাকা পাবেন। সব মিলিয়ে তিনি পাবেন ৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা, যা সচিবের বেতনের প্রায় ৯ গুণ। প্রকল্প পরিচালকের গাড়ি চালকের বেতন ধরা হয়েছে ৭৩ হাজার ৭০৮ টাকা। অথচ বর্তমানে সচিবের বেতন ৭৮ হাজার টাকা। রাঁধুনি আর মালীর বেতন ৬৩ হাজার ৭০৮ টাকা। একইভাবে উপপ্রকল্প পরিচালক, অতিরিক্ত পরিচালকসহ অন্যসব পদেই অস্বাভাবিক বেতন-ভাতা ধরা হয়েছে।
এছাড়াও পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক পাবেন ৩ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। তিনি প্রকল্পের স্টেশন ডিরেক্টর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এজন্য অতিরিক্ত ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা পাবেন তিনি। এতে তার মোট বেতন দাঁড়াবে ৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। প্রকল্পের রাশিয়া অফিসের পরিচালকের বেতন ধরা হয়েছে ৩ লাখ ২১ হাজার টাকা করে। কারিগরি ও প্রশাসনিক অন্যান্য পদের বেতনও অনেক বেশি ধরা হয়েছে। এছাড়াও বেতনের বাইরে বার্ষিক সর্বোচ্চ ৩ মাসের মূল বেতনের সমান চিকিৎসা ভাতা, মাসিক ৩ থেকে ৬ হাজার টাকা যাতায়াত ভাড়া, মাসিক ১০ থেকে ১৫ হাজার সন্তানদের শিক্ষা ভাতা, মূল বেতনের ৪০ শতাংশ হারে মাসিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং তেজস্ক্রিয় ভাতা এবং ২০ শতাংশ হারে শিফট ভাতা ও বিদ্যুৎ বিল ভাতা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এরই মধ্যে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগে গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলমকে প্রত্যাহার করে গণপূর্ত অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। মাসুদুল আলম একজন মধ্যম শ্রেণির কর্মকর্তা। সে হয়তো সুবিধাভোগী; কিন্তু সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় সরকারের বড় বড় রুই-কাতলা ও রাঘব বোয়ালরা রয়েছেন। লাভের গুড় সে নিশ্চয়ই একা খায়নি! তবে বলির পাঁঠা কেন সে একা হবে? এছাড়া দুর্নীতি যে হয়েছে, সেটা তো প্রমাণিত। তাহলে কেন শুধু প্রত্যাহার ও সংযুক্ত করা হলো? গ্রেপ্তার কেন করা হলো না? প্রত্যাহার ফ্যাশন বাদ দিয়ে বিচারের ফ্যাশন চালু করতে হবে। শুধু প্রত্যাহার করে নেপথ্যের কুশিলবদের আড়াল করা চলবে না! যদিও প্রত্যাহার কোনো শাস্তি নয়। এত উচ্চমূল্যে কাজ দিয়ে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি আর অনুমোদন কমিটিই বা কী করল, সেটাই দ্রুত বিবেচনায় আনা উচিত। কারও ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙে রাঘব বোয়ালদের বাইরে রাখা কতটা যুক্তিসঙ্গত! সে হয়তো চোর; কিন্তু চোর সে একা নয়! শুধু তাকে ধরলে হবে না, চোরের ‘মাসতুত ভাই’ যারা তাদেরও ধরতে হবে।
বর্তমান সরকার আরও বেশ কিছু যুগান্তকারী মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। সেসব প্রকল্পে অনুরূপ দুর্নীতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে কি না, তা সংশ্লিষ্টদের খতিয়ে দেখতে হবে। গ্রিনসিটি প্রকল্পের দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে তা অন্যান্য প্রকল্পের কর্মকর্তাদের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে।
মোহাম্মদ আবু নোমান
কলামিস্ট[email protected]