ঈদ মানেই আনন্দ। আর এ আনন্দ তখনই পূর্ণতা লাভ করে, যখন পরিবারের সবাই একত্রে মিলিত হয়ে উদযাপন করার সুযোগ মেলে। এ আনন্দ আপনার-আমার সবার ক্ষেত্রেই। জীবিকার প্রয়োজনে ইট-কাঠের শহরে আবাস গড়লেও আমাদের সবার মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও অর্থাৎ নিজ গ্রামে। যেখানে রয়েছে মানুষের নাড়ির টান। বাড়ি বহুদূর হলেও ঈদের মধ্যে প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হতে চায় সবাই। খুশিকে আরও পরিপূর্ণ করতে এবং আপনজনকে দেখার আকাক্সক্ষা মেটাতে পথের কষ্ট নিয়ে ভাবে না কেউ। যেভাবেই হোক ঈদে বাড়ি পৌঁছানো চাই! তা যাহোক, প্রতি বছরের মতো এবারও হয়তো ঈদ আনন্দ সবাই একত্রে উদযাপনের লক্ষ্যে ঈদের আগেই স্ত্রী-সন্তানসহ নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশে যাত্রার পরিকল্পনা করা শেষ। অন্য সব যানবাহনে ভ্রমণের চেয়ে রেলে ভ্রমণের আনন্দটা যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশেষ করে আমার একমাত্র কন্যা আফিয়া, তার কাছে ভ্রমণ মানেই ট্রেন। ট্রেনে ভ্রমণ ছাড়া সে যেন অন্য কোনো যানবাহন চিন্তাই করতে পারে না। রেলে ভ্রমণ তার জন্য ভীষণ আনন্দের কারণ। ট্রেনের ঝক ঝক শব্দ, যানজটবিহীন পথ চলা সত্যিই আনন্দদায়ক। দেশে এবং বিদেশে অসংখ্যবার ট্রেনে ভ্রমণ করার সুযোগও হয়েছে। প্রতিটি ভ্রমণের মাঝেই যেন লুকিয়ে থাকে নানা অভিজ্ঞতার কথা। গেল বছর ঈদে নিজ বাড়ি পঞ্চগড় থেকে ফেরার সময় টিকিট নিয়ে হয়েছিল তিক্ত অভিজ্ঞতা। ছুটি শেষে ঢাকা ফেরার পালা। পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ডোমার, চিলাহাটি কোনো স্টেশন থেকে কোনোভাবেই রেলের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে আমার মেয়ের বায়না রেলে করেই সে ঢাকায় আসবে। স্টেশনগুলোতে গিয়ে দেখা গেল সাধারণ মানুষের জন্য বরাদ্দ টিকিটের একটিও তারা পাচ্ছেন না, সব চলে যাচ্ছে কালোবাজারিদের হাতে। স্টেশন মাস্টারের কাছে টিকিট নেই, পাওয়া যাচ্ছে চায়ের দোকানে বসে থাকা স্থানীয় লোকদের কাছে। ঢাকাগামী বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হলে আসল চিত্র ফুটে ওঠে।
এটি কি শুধু একটি জেলার সমস্যা? না, এ সমস্যা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জেলার। বিশেষ করে ঈদ মৌসুমে টিকিট কালোবাজারিরা স্টেশন-কেন্দ্রিক বেপরোয়া হয়ে ওঠে। যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করে নেয় অতিরিক্ত অর্থ। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিটি জেলায় রেলের টিকিটের ক্ষেত্রে কালোবাজারি চক্র সবসময় সক্রিয় থাকে, এদের হাত থেকে সাধারণ জনগণ কি কখনও মুক্তি পাবে না? লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছি। আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে খুব ভালোবাসি। এ দেশে জন্মগ্রহণ করেছি বলে আমরা গর্ববোধ করি। খুব কষ্ট লাগে তখন, যখন দেখি দেশের সুনাম নষ্ট করার জন্য একটি কুচক্রীমহল সক্রিয় থাকে। আমরা কি আমাদের বুকের রক্ত এজন্যই বিলিয়ে দিয়েছিলাম; যেন এসব কালোবাজারি আর অসৎ চক্রের হাতে জিম্মি থাকি? না, এটা কোনোভাবেই চলতে দেওয়া যেতে পারে না। এসব অসৎ চক্রের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের সবার ঐক্যই পারে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে সব ধরনের অসৎ চক্রের হাত থেকে মুক্ত করতে।
আমাদের পাশের দেশ ভারতে বেশ কয়েকবার ভ্রমণ ও চিকিৎসাসেবার জন্য যাওয়ার সুযোগ হয়। সে দেশে রেলে ভ্রমণ সত্যিই আনন্দদায়ক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কয়েক মাস আগেই রেলের টিকিট অগ্রিম করার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রত্যেক ভ্রমণকারীর নাম, সিট নম্বর, বয়স সবকিছুই টিকিটে উল্লেখ থাকে। শুধু তা-ই নয়, স্টেশনে এবং যে বগিতে আপনার সিট সে বগির বাইরেও নামের তালিকা ঝুলানো থাকে। টিকিট ছাড়া যাত্রীরা ভ্রমণ করছেন, এ বিষয়টি কখনই আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। এছাড়া টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে কালোবাজারিদের কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে, কেননা প্রত্যেকটি টিকিটে পরিচয় উল্লেখ থাকে। একবার পাঞ্জাব থেকে কলকাতায় আসছিলাম, আমরা ১০ থেকে ১৫ জন ছিলাম। আমাদের মধ্য থেকে একজন দিল্লি চলে গেলে তার টিকিটটি আমাদেরই আরেকজন বৃদ্ধ বয়সি যিনি টিকিট করতে পারেননি তার কাছে বিক্রি করে। আমরা ভেবেছিলাম টিকিট ও সিট যেহেতু আছে তাহলে সমস্যা কী। বেশ কিছুক্ষণ পর দুই ব্যক্তি এসে টিকিট চাইলেন। একেক করে সবার টিকিট চেক করা হয়ে গেলে যিনি আরেকজনের টিকিট দিয়ে যাত্রা করছিলেন তার টিকিট চেক করতেই বললেন আপনার পরিচয়পত্র দিন। যেহেতু বাংলাদেশি ছিলেন, তাই পাসপোর্ট বের করে দেখালেন, টিকিটে যার নাম এবং বয়স উল্লেখ আছে তার কিছুই মিল খুঁজে না পেয়ে তার কাছ থেকে টিকিটের দ্বিগুণ মূল্য জরিমানা স্বরূপ আদায় করলেন। এক্ষেত্রে এরা এমন যে, একজনের নামে টিকিট কেটে অন্যজন যাতে যেতে না পারে, সে ক্ষেত্রে তারা কঠিন পদক্ষেপ নিয়ে থাকে, কারও আইডি কার্ডের সঙ্গে যদি টিকিট না মেলে, তাহলে জরিমানা ছাড়া জেলও হতে পারে। আমাদের দেশে রেলের টিকিট পাওয়া যায় না, আর টিকিট পাওয়া যায় কালোবাজারির কাছেÑ এটা শুনলে ভারতীয়রা হাসাহাসি করে।
বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত, এত বড় দেশ, তারা যদি তাদের টিকিট কালোবাজারিদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারছি না। প্রায়ই টিকিট কালোবাজারিদের বিষয়ে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রচার হয়, আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ চক্রের সঙ্গে যে রেলওয়ের একশ্রেণির অসাধু কর্মচারীর যোগসাজশ রয়েছে, তা-ও উল্লেখ করা হয়। তারপরও এ বিষয়ে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
তবে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, আমাদের বর্তমান রেলপথমন্ত্রী রেলওয়ের উন্নয়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, আর এক্ষেত্রে এরই মধ্যে তিনি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছেন বলে আমার ধারণা। কেননা একটি কথা তিনি বরাবরই বলে থাকেন, ‘মানুষ যেন স্বস্তিতে, স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারে, সেটিই আমার মূল লক্ষ্য।’ এ লক্ষ্যে তিনি কাজও করে যাচ্ছেন। যেমন টিকিট কালোবাজারিদের হাত থেকে রক্ষা পেতে বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনের সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট কাটতে হলে এনআইডি কার্ড প্রয়োজন হয়। এ ব্যবস্থা যদি প্রতিটি ট্রেনের টিকিটের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়, তাহলেও হয়তো টিকিট কালোবাজারিদের হাত থেকে অনেকটা রেহাই পাওয়া যাবে। আমরা রেলপথমন্ত্রীর কাছে জোর দাবি জানাই, টিকিট কালোবাজারিদের বিষয়েও যেন কঠোর কোনো প্রদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেন। যদিও সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে রেলমন্ত্রী বলেছিলেন, ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। দুর্নীতি যদি পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। এ ব্যাপারে আমাদের নির্বাচনি ইশতেহার আছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ আমরা অক্ষরে অক্ষের পালন করব। (১৪ জানুয়ারি ২০১৯, প্রথম আলো)। এ অঙ্গীকারের কতটা বাস্তবায়ন হয়, তা-ই এখন দেখার বিষয়। সম্প্রতি সরকার বন্ধ স্টেশন চালুর উদ্যোগ নিয়েছে এবং এরই মধ্যে বেশকিছু স্টেশন চালুও করেছে। বাকিগুলো চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। এটা অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এতে নতুন কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি হবে। শেষে আবারও কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, রেলের টিকিট কালোবাজারিদের হাত থেকে সাধারণ জনগণকে রক্ষা করুন, যাতে দেশের মানুষ শান্তিতে রেলে ভ্রমণ করতে পারে এবং স্বস্তির সঙ্গে বিভিন্ন উৎসব উপভোগ করতে পারে। হ
ষ মাহমুদ আহমদ
প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক, মাসিক আহ্বান[email protected]