চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করা হচ্ছে। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরেও রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। আর লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া নতুন কিছু নয়। প্রতি বছরই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে
আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পৌনে ৪ লাখ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে সংবাদমাধ্যমে। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআরের) আওতায় রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হচ্ছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ সময়ে রাজস্ব আয়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। গত অর্থবছরে একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে ২ লাখ ৩ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আহরণ হয় ১ লাখ ৫২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এ সময়ে আয় হয় ১ লাখ ৪৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। এ রকম এক পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করা হচ্ছে। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরেও রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। আর লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া নতুন কিছু নয়। প্রতি বছরই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের মূল লক্ষ্যমাত্রা থেকে ১৬ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। যদিও এনবিআরের প্রস্তাব আড়াই লাখ কোটি টাকার। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের প্রধান তিন খাতে (আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক) বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত ভ্যাটে ঘাটতি হয় ১৯ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা। এছাড়া আয়কর ও আমদানি শুল্কে ঘাটতি যথাক্রমে ১৭ হাজার ও ১৫ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, ভ্যাটে আলোচ্য অর্থবছরের ৯ মাসে ৭৮ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আহরণ হয় ৫৯ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। আমদানি শুল্কের ৬২ হাজার ৮৩ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া আয়করে ৬৩ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। এর বিপরীতে মার্চ পর্যন্ত আয় দাঁড়ায় ৪৬ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। তবে তিনটি আয়ের উৎসের মধ্যে তুলনামূলকভাবে আয়করের প্রবৃদ্ধি মোটামুটি সন্তোষজনক। ৯ মাসে আয়করে প্রবৃদ্ধি হয় ১২ শতাংশ। এনবিআর কখনোই এর আগের বছরের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় করতে পারেনি। অর্থবছরের অতি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা এনবিআরের পক্ষে কখনোই অর্জন করা সম্ভব নয়। এবারের বাজেট উচ্চাভিলাষী; কিন্তু আমি তা মনে করি না। বাজেটের এ ধরনেরই আকার হওয়া উচিত। কিন্তু এ উচ্চাভিলাষ পূরণে যে চেষ্টার প্রয়োজন, তা অনুপস্থিত। আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। কর ব্যবস্থা সংস্কার করা হলে এ উচ্চাভিলাষ পূরণ সম্ভব। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকের পর থেকে কর ব্যবস্থায় মৌলিক কোনো সংস্কার আনা হয়নি। ১৯৯১ সালে ভ্যাট প্রবর্তনের পর অনেক ধরনের ডিসটরশন এতে প্রবেশ করেছে। এর একটি হচ্ছে প্যাকেজ ভ্যাট। এবার প্রস্তাব ছিল, ভ্যাট আইনকে প্যাকেজ ভ্যাটের পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে অর্থমন্ত্রী সংগত কারণেই এটা থেকে পিছিয়ে এসেছেন। প্যাকেজ ভ্যাটের হার বাড়ানো হলেও সংস্কার এ বছরের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখানে একটি মূল সমস্যা আড়ালেই থেকে গেছে আর সেটি হলো, ভ্যাটের উচ্চহার। এটির সমাধান না করলে ভ্যাটের সুফল পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশে ভ্যাটের হার অনেক বেশি, ১৫ শতাংশ। এক্সাইজ ডিউটিকে পরিবর্তন করে ভ্যাট প্রবর্তন করা হয়। যখন ভ্যাট প্রবর্তন করা হয়েছিল, তখন আমি এনবিআরে কাজ করতাম। তখন হিসাব করে দেখেছিলাম, ভ্যাটের হার যদি ১০ শতাংশ করা হয়; তবে এক্সাইজ ডিউটি উঠে যাওয়ার ফলে যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের চাপে ভ্যাটের হার ১০ শতাংশ করার বিষয়ে আমরা সরকারকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। আমি সে সময় বলেছিলাম, করহার উচ্চ হলে তাতে বিভিন্ন ডিসটরশন প্রবেশ করবে। আরেকটি বিষয় হলো, ওয়েলফেয়ার কস্ট অব ট্যাক্সেশন বলে একটি কথা রয়েছে। এটি করহারের সঙ্গে সংযুক্ত। করের হার দ্বিগুণ করলে এটি দ্বিগুণ, এমনকি দ্বিগুণের বেশি হারে বাড়ে। ভ্যাটের হার না কমালে এটিকে আধুনিক করা যাবে না। এছাড়া আমাদের বর্তমান যে প্রশাসন ব্যবস্থা রয়েছে, তার মাধ্যমে ভ্যাটের আইডিয়াল সিস্টেম কতটা বাস্তবায়ন করা যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
মোদ্দাকথা, ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ রেখে বিদ্যমান ডিসটরশন কমানো যাবে না। সংস্কার চাইলে এ উচ্চহার কমাতে হবে। বাজেট ঘোষণার পর পত্রিকায় সবসময় লেখা হয়, কোন পণ্যের দাম কমবে আর দাম বাড়বে। আমাদের এখানে যে প্রক্রিয়া রয়েছে, তা হলো বাজেটের আগে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন দাবি দেন। সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি হয়। কিন্তু এবারের বাজেট নিয়ে ব্যবসায়ীরা হতাশ। অর্থাৎ তারা যে দাবি-দাওয়া দিয়েছেন, তা পূরণ হয়নি। দেশের বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠনের সঙ্গে সরকারের আলোচনা হয়। তাদের বেশিরভাগ প্রস্তাবই গৃহীত হয় না। কারণ তারা বেশিরভাগ সময়ই কর কমাতে বলেন। দেখা যায়, একটি যুক্তিতে কোনো একটি পণ্যের শুল্ক বাড়ানো হলো। পরের বছর আবার আরেকটি যুক্তি দেখিয়ে শুল্ক কমানো হয়। আমার কাছে এটি একটি অর্থহীন প্রক্রিয়া মনে হয়। এবারের বাজেটে মোটরসাইকেলের ওপর সম্পূরক শুল্ক ৪৫ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। এটি করার উদ্দেশ্য কী? মোটরসাইকেলের ব্যবহার বাড়ানো আমি সমর্থন করি। যানজটে মোটরসাইকেল ভালো ফল দিতে পারে। কিন্তু মোটরসাইকেলের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য সম্পূরক শুল্ক কমাতে হবে কেন? আমাদের দেশ বাইসাইকেল রপ্তানি করে। বাংলাদেশ কি মোটরসাইকেল উৎপাদন এমনকি রপ্তানি করতে পারে না? এগুলো উৎপাদনে বড় প্রযুক্তির প্রয়োজন পড়ে না। এগুলোও কি আমরা উৎপাদন করতে পারব না? যে প্রক্রিয়ার কথা বললাম এটি লবির মতো। মোটরসাইকেলের পার্টস আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক হ্রাসের পেছনে ভারতের মোটরসাইকেল রপ্তানিকারকদের ভূমিকা বা প্রভাব কাজ করতে পারে।
ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম
বীর মুক্তিযোদ্ধা
সাবেক কর কমিশনার ও চেয়ারম্যান ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন