ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিতে শনিবার শ্রদ্ধা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মো. আখতারুজ্জামান - আলোকিত বাংলাদেশ
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় জাতি স্মরণ করল বাংলাদেশের জাতীয় কবি, প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। কবির ১২০তম জন্মবার্ষিকীতে তার সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ।
শনিবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত কবির সমাধিতে রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ শ্রদ্ধা জানান। এছাড়া রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কবির সংগ্রামী জীবন নিয়ে আলোচনা সভা, গান ও কবিতার মাধ্যমেও শ্রদ্ধা জানানো হয় বিদ্রোহী কবিকে। এবার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়Ñ ‘নজরুল-চেতনায় বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’।
এ বছর জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত ময়মনসিংহে। কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ত্রিশালের দরিরামপুর সেজেছে নতুন সাজে। এ উপলক্ষে নজরুল মঞ্চে সংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ও জেলা প্রশাসনের আয়োজনে তিন দিনব্যাপী জাতীয় পর্যায়ে জাতীয় কবির ১২০তম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
শনিবার সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা জানায় হাজার হাজার মানুষ। সকালে ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে
বিশ্ববিদালয়ের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শোভাযাত্রা সহকারে কবির সমাধিতে যান এবং কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে এসে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম সারা জীবন অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের জন্য তার কবিতা, গল্পের মধ্যে দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সব সময় কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ছিলেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করেছিলেন তিনি। ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে সাংবিধানিক ঘোষণার নথিপত্র আছে কি নাÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কবি নজরুল ইসলামকে বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন এবং জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছিলেন। আমরা জানি, তিনি আমাদের জাতীয় কবি। এটার কোথায় প্রজ্ঞাপন আছে কি না, সেটা সরকার সংশ্লিষ্টরা বলতে পারবেন। কবিকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। এটি নিয়ে নতুন করে ভাবনার ও বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই।
কবির সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, নজরুল ইনস্টিটিউট, জাসাস ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবক লীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পক্ষে সংগঠনটির বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন, আওয়ামী লীগের মহানগর ইউনিট, যুবলীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
শ্রদ্ধা জানানো শেষে কবির মাজার প্রাঙ্গণে ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে এক স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, প্রো-ভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দীন এবং ঢাবি নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. আকতার কামাল। অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. এনামউজ্জামান। বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ভীষ্মদেব চৌধুরী অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন। অনুষ্ঠানে নজরুল সংগীত পরিবেশন করেন সংগীত বিভাগের শিক্ষক ড. মহসিনা আক্তার খানম (লীনা তাপসী), খায়রুল আনাম শাকিলসহ বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার, সম্প্রীতির, সাম্যের ও মানবতার কবি হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, তিনি সবসময় অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে ও অসাম্যের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদী ছিলেন। তার লেখা গান, কবিতা, গল্প ও উপন্যাস আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
ত্রিশাল উপজেলা প্রতিনিধি জানায়, জাতীয় কবির বাল্য স্মৃতিবিজড়িত ময়মনসিংহের ত্রিশালে কবি নজরুলের ১২০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ত্রিশালের দরিরামপুর সেজেছে নতুন সাজে। এ উপলক্ষে নজরুল মঞ্চে সংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ও জেলা প্রশাসনের আয়োজনে শনিবার থেকে তিন দিনব্যাপী জাতীয় পর্যায়ে জাতীয় কবির ১২০তম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি, তিনি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৩০৬ সালে ১১ জ্যৈষ্ঠ জন্মগ্রহণ করেন। ‘চির উন্নত মম শির’ বলে কাজী নজরুল ইসলাম সারাটি জীবন সংগ্রাম করেছেন শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে। মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি নেমে ছিলেন জীবিকা অর্জনে। ত্রিশালের রফিজউল্লাহ দারোগা তাকে দরিরামপুর হাইস্কুলে ভর্তি করে লেখা পড়া এবং থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
সংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ বাবু এমপির সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখবেন ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ত্রিশালের সাংসদ হাফেজ মাওলানা রুহুল আমিন মাদানী, সংসদ সদস্য অসীম কুমার উকিল, বিশ^ভারতী বিশ^বিদ্যালয় শান্তিনিকেতন ভারতের উপাচার্য অধ্যাপক বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। স্মারক বক্তা রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. বিশ^জিত ঘোষ, ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক সুভাষ চন্দ্র মাঝি।
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানায়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে দিবসটির কার্যক্রম শুরু হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয় সেমিনার কক্ষে নজরুলজয়ন্তী ২০১৯ আলোচনা সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. এএইচএম মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে মুখ্য আলোচক হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ ও ভারত বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন ট্রেজারার অধ্যাপক মো. জালাল উদ্দিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সুব্রত কুমার দে। স্বাগত বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম। আলোচক হিসেবে ছিলেন কর্মকর্তা পরিষদের সভাপতি মো. মোকারেরম হোসেন মাসুম। সঞ্চালনায় ছিলেন ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজের উপ-পরিচালক রাশেদুল আনাম। সংগীত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আশিক সরকার ‘সমসাময়িক সংগীত রচয়িতাদের গান অনুসরণে নজরুলের ভাঙাগান’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন। দোয়া ও ইফতার মাহফিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রথম দিনের কর্মসূচি শেষ হয়।
সিলেট ব্যুরো জানায়, প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিভাগীয় নগরী সিলেটে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হয়েছে। শনিবার সকালে নগরীর রিকাবীবাজারের নজরুল চত্বরে কবির অস্থায়ী প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপও করেন। তিনি নজরুলের দেশপ্রেমের চেতনাকে লালন করে দেশের উন্নয়নে সবাইকে অংশীদার হওয়ার আহ্বানও জানান। সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীও জাতীয় কবির প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এছাড়া সিলেট প্রেসক্লাব, সিলেট নজরুল পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, কথাকলি, লিটল থিয়েটারসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগেও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। পরে কবি নজরুল অডিটরিয়ামের মুক্ত মঞ্চে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ এ দিনে তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। ১৯৭২ সালে তৎকালীন সরকার তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসে।