আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ২৬-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

আরশের পানে খুলে রাখ হৃদয়ের জানালা

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
| প্রথম পাতা

আজ বিশ রমজান। ইফতারের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে একুশে রমজান। পবিত্র মাহে রমজানের সবচেয়ে আবেগঘন, গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের শুরু। হাদিস শরিফের ঘোষণা অনুযায়ী ‘ইতকুম মিনান্নার’। অর্থাৎ দোযখ থেকে মুক্তির শেষ দশক, যাকে এক কথায় নাজাতের দশক বলা যায়। এ দশকে আল্লাহ পাক উম্মতে মুহাম্মদীর অগণিত অসংখ্য মানুষের দোযখ থেকে মুক্তির ফায়সালা দেন। এ দশকে পবিত্র শবেকদর লুকায়িত থাকায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। শব ফারসি শব্দ, আরবিতে বলা হয় লাইল। লাইলাতুল কদর বা সম্মানিত রাতটির এতই মহিমা যে, আল্লাহ পাক কুরআন নাজিলের সূচনা করেন এ রাতে। এ রাতের ফজিলত বর্ণনায় একটি স্বতন্ত্র সূরা নাজিল করেন, যার নাম সূরা কদর, আমরা বলে থাকি ‘ইন্না আনযালনা’। এ রাতের অনেক বৈশিষ্ট্যের একটি হলো এ একটি রাত এক হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। অর্থাৎ একটি রাত ইবাদত বন্দেগিতে কাটিয়ে দেওয়া একটানা এক হাজার মাস বা ৮২ বছর ৪ মাস ইবাদত বন্দেগিতে কাটানোর চেয়ে উত্তম। অনেকের মতে এখানে এক হাজার মাস সীমিত সংখ্যা বুঝানোর জন্য বলা হয়নি; বরং সীমা 

সংখ্যাহীন বুঝানোর জন্য পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়েছে। গভীরভাবে চিন্তা করলে অবাক হতে হয়। কারণ, এ ঘোষণা তো স্বয়ং আল্লাহ তাআলার এবং পবিত্র কোরআনের একটি স্বতন্ত্র সূরার মাধ্যমে তা মানব জাতিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, এ রাতে অগণিত ফেরেশতা আসমান থেকে জমিনে নেমে আসেন এবং তাদের নেতৃত্বে থাকেন ওহিবাহক ফেরেশতা জিবরাঈল (আ)। তারা সমগ্র জগতে শান্তির পশরা বিলান, তখন পূর্ণিমা রাতে জোছনার বন্যার মতো আল্লাহর রহমত ও শান্তির সওগাত থৈথৈ করে চারদিকে। 

আকাশ ভেঙে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামলেও জমি যদি পাথুরে হয় বা বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা না থাকে তাহলে বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব শুকিয়ে যায়। অনুরূপ শবেকদরে আল্লাহর রহমতের মুষলধারে বরিষণ হলেও বান্দার দিলের জমি যদি পাথুরে হয় বা রহমত ধারণ করার জন্য অন্তরের পাত্রখানি আরশের পানে উন্মুখ হয়ে না থাকে তাহলে কিছুই ধারণ করা সম্ভব হবে না। 

ছয় ঋতুর দেশে আমরা শীত বসন্ত ভালো করে ফারাক করতে পারি না। চার ঋতুর দেশগুলোতে শীতের পর বসন্ত এলে বিশ্বপ্রকৃতি মরণের পর জীবন নিয়ে জেগে ওঠে। আমাদের দেশে বর্ষাকালে মাছের উৎসব হয়। কৃষকদের ঘরেও আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। শীতের মওসুমে রবিশস্যে বসন্তের আবহ ফুটে ওঠে। বিশ্বপ্রকৃতিতে ঋতুচক্রের আবর্তন বিবর্তনের মতো অতিপ্রাকৃতিক জগতেও শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত আছে। রমজানে, বিশেষ করে শবেকদরে সেই বসন্তের সমারোহ জাগে। এ সমারোহ জীবনে ধারণ করার জন্য সাধনা করতে হয়। সেই সাধনার একটি হলো এতেকাফ।

নবী করিম (সা) একবার রমজানের প্রথম ১০ দিন এতেকাফ নেন। এরপর মাঝখানের ১০ দিন এতেকাফ নেন। পরে তিনি সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি শবেকদর তালাশ করার জন্য প্রথম ১০ দিন এতেকাফ নিয়েছিলাম। পরে আরও ১০ দিন এতেকাফ নিয়েছিলাম। পরে আমাকে জানানো হয় যে, শবেকদর রমজানের শেষ দশকে। কাজেই তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে শবেকদর তালাশ কর। এ হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয়, শবেকদর তালাশের সবচেয়ে বড় উপায় এতেকাফ। যাদের আল্লাহপাক সংসারের ঝামেলা চুকিয়ে আজ থেকে ঈদের চাঁদ দেখা পর্যন্ত মসজিদে অন্তরীণ হওয়ার তওফিক দিয়েছেন, মনে রাখতে হবে যে, শবেকদর তালাশ করাই এতেকাফের মূল লক্ষ্য। কখন আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি হয় তার জন্য মনের জমিন প্রস্তুত এবং হৃদয়ের পাত্রটি আরশের পানে তুলে ধরতে হবে। এখানে মোবাইল ফোন নিয়ে দুনিয়ার ব্যস্ততায় মেতে থাকার অর্থ হয় না।

নানা ব্যস্ততার কারণে যাদের পক্ষে ১০ দিনের এতেকাফ সম্ভব নয়, তারাও নিরাশ হওয়ার কারণ নেই। কারণ, এতেকাফ একদিন বা কয়েক দিন কিংবা কয়েক ঘণ্টার জন্যও হতে পারে। বেছে বেছে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতেও যদি মসজিদে ছুটে আসা সম্ভব হয়, কিংবা মা বোনেরা ঘরের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিজেকে আবদ্ধ রেখে ইবাদতে নিমগ্ন হন, অন্তত শবেকদর তালাশকারীদের খাতায় নামটা অবশ্যই উঠবে। একদিন বা একরাত সম্ভব না হলে কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও আল্লাহর এত বড় নেয়ামতকে বুকে ধারণ করার জন্য সময় বের করা চাই। দুনিয়া তো আছেই। দুনিয়া নিজস্ব গতিতে চলবে। আমি না থাকলেও দুনিয়ার গতি থামবে না। আমার আপনার উচিত এ দুনিয়ার পরের জীবনের জন্য কিছু পাথেয় সংগ্রহ করা। 

যারা কর্মস্থলে, রাস্তাঘাটে থাকতে বাধ্য, তাদেরও উচিত, এ মহা নেয়ামত লাভের উদ্দেশ্যে হৃদয়ের জানালা আকাশের দিকে খোলা রাখা আর একটি দোয়া পড়তে থাকা। হযরত আয়েশা (রা) নবী করিম (সা)-এর কাছে জানতে চান, আমি যদি বুঝতে পারি আজ শবেকদর, তখন কী বলব, কী চাইব? নবীজি বললেন, তুমি বলবে, আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা-ফু আন্নি’ Ñ‘প্রভু হে, তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে তুমি পছন্দ কর। কাজেই তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও।’