শবেকদরের আরবি হচ্ছে লাইলাতুল কদর। আরবি ভাষায় লাইলুন শব্দের অর্থ রাত। আর কদর শব্দের অর্থ সম্মান, মর্যাদা। সুতরাং লাইলাতুল কদরের অর্থ হচ্ছে মর্যাদাপূর্ণ ও মহিমান্বিত রাত। তাফসিরে কুরতুবিতে বলা হয়েছে, শবেকদর অর্থ ভাগ্য নির্ধারণ রাত। এ রাতে পরবর্তী এক বছরের ভাগ্যলিপি সংশ্লিষ্ট ফেরেশতার কাছে হস্তান্তর করা হয়। আগামী বছর মানুষের জীবন, মরণ, খাদ্য, বৃষ্টির পরিমাণ ইত্যাদি লিখে দেওয়া হয়। চলতি বছর কে হজ করবেন, তা-ও নির্ধারণ হয়ে থাকে।
শবেকদরের ফজিলত : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার বনি ইসরাইলের জনৈক ব্যক্তির ব্যাপারে বলেন যে, ‘বনি ইসরাইলের জনৈক ব্যক্তি পুরো রাত ইবাদতে কাটিয়ে দিত এবং সারা দিন জিহাদে লিপ্ত থাকত। এভাবে সে ১ হাজার মাস পর্যন্ত কাটিয়ে দিত।’ এ কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম দারুণভাবে প্রভাবিত হলেন এবং পরিতাপ করলেন যে, আমাদের তো এত দীর্ঘ হায়াত পাওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং এমন মর্যাদা প্রাপ্তিও তো সুদূরপরাহত! সাহাবায়ে কেরামের এমন পরিতাপের দাবিতে এবং শেষ জমানার উম্মতের শ্রেষ্ঠত্বের পূর্ণতাদানের সুযোগ হিসেবে মহান আল্লাহ ‘সূরা কদর’ নাজিল করে মুসলিম উম্মাহকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সুযোগ করে দিলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মহিমান্বিত কদর রাতে। আপনি কি জানেন, কদরের রাত কি? মর্যাদাপূর্ণ কদর রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতারা এবং হজরত জিবরাইল (আ.) অবতরণ করেন তাদের মহান প্রভুর নির্দেশক্রমে, সব বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে ফজরের উদয় পর্যন্ত। (সূরা কদর : ১-৫)। এ সূরার মাঝে কদরের রাতকে হাজার মাস থেকেও শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। হাজার মাসে প্রায় ৮৩ বছর চার মাস হয়। এ হিসাবে কেউ যদি জীবনে ১২টি রমজানে লাইলাতুল কদরের ফজিলত অর্জন করতে পারে, তখন সে ১ হাজার বছর ইবাদত করার চেয়েও বেশি ফজিলত পেয়ে যাবে। সুবহানাল্লাহ! মূলত কোরআন নাজিলের কারণেই শবেকদরের এত মর্যাদা। কোরআন অনুযায়ী জীবন গড়তে পারলে শবেকদরের পরিপূর্ণ ফজিলত পাওয়া যাবে।
শবেকদর অন্বেষণ : রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের প্রতীক্ষায় সারা বছর প্রহর গুনতেন। কদরের ফজিলত পেতে কদরের রাত সন্ধানের প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলতেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় (২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯) রাতগুলোতে শবেকদরকে অন্বেষণ করো।’ (মুসলিম)। রমজানের শেষ দশকে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইবাদতের জন্য প্রস্তুতি নিতেন, রাত জেগে ইবাদত করতেন, নিজের পরিবারবর্গকে জাগিয়ে দিতেন। (বোখারি)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) গাণিতিক সূত্রের মাধ্যমে ২৭ রজনিকে কদরের অধিক সম্ভাব্যতা প্রমাণ করে বলেছেন, ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয়ে নয়টি আরবি বর্ণ রয়েছে; আর সূরা কদরে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয় তিনবার রয়েছে; নয়কে তিন দিয়ে গুণ করলে সাতাশ হয়; তাই সাতাশে রমজানের রাতে কদর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। (রুহুল বয়ান)।
ক্ষমাপ্রার্থনা করা : রাসুল (সা.) কদরের রাতে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার শিক্ষা দিয়েছেন। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে আমি ওই রাতে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তুমি বলবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন। (ইবনে মাজাহ)।
ইতেকাফ করা : রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো শবেকদর প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। ইতেকাফের মাধ্যমে বান্দা সবকিছু ছেড়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়ে শবেকদর সন্ধান করতে থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় কদরের রাত জেগে ইবাদত করবে, তার অতীতের গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বোখারি)।
নফল ইবাদত করা : কদরে রাতে বেশি বেশি নফল নামাজ যেমন তাহাজ্জুদ, সালাতুত তসবি পড়া; অধিক পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত করা; দরুদ শরিফ পড়া; জিকির-আজকার করা; নিজের জন্য, বাবা-মায়ের জন্য ও সব মুসলমানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা।
শবেকদরে উদাসীন না থাকা : শবেকদরে নিজেকে গাফেল রাখা বিবেকবান মানুষের কাজ নয়। কারণ শবেকদরের ফজিলত থেকে বঞ্চিত হওয়া সব কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হওয়ার নামান্তর। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এ মাসে এমন একটি রাত রয়েছে, যা হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, যে ব্যক্তি এই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত, সেসব কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।’ (নাসাঈ)।